হিজাব পরা বা না-পরা ব্যক্তিগত বিষয়, সরকারের সেখানে হস্তক্ষেপের অধিকার নয়৷ মত ইরানের অধিকাংশ মহিলার৷ সরকারের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে৷
বিজ্ঞাপন
ইরানের অধিকাংশ মহিলা আর হিজাবের আড়ালে থাকতে চান না৷ তাঁদের বক্তব্য, হিজাব পরা বা না-পরা একেবারেই ব্যক্তিগত পছন্দ৷ সরকার বা রাষ্ট্র তা কখনোই ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিতে পারে না৷ সম্প্রতি ইরান সরকারের প্রকাশিত এক রিপোর্টেই এই তথ্য স্পষ্ট হয়েছে৷ সূত্রের খবর, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সবুজ সংকেত পাওয়ার পড়েই রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছে৷
বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কারণ, গত কয়েকমাস ধরে ইরানের মহিলারা এক নতুন আন্দোলন শুরু করেছেন৷ প্রকাশ্য রাস্তায় হিজাব খুলে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন তাঁরা৷ শুধু তাই নয়, তাঁদের সেই প্রতিবাদ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আপলোডও করে দিচ্ছেন৷ কয়েকদিন আগে এই কারণেই অসংখ্য মহিলাকে গ্রেফতার করেছিল ইরান পুলিশ৷ কারণ ইরানের ইসলামিক আইন অনুযায়ী, মহিলাদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক৷ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, মেয়েদের চুল ঢাকতে হবে এবং শরীরের সমস্ত অংশ ঢেকে রাখতে হবে৷ প্রতিবাদ শুরু হয়েছে এর বিরুদ্ধেই৷
যে রিপোর্টটি ইরান সরকার প্রকাশ করেছে, সেটা তিন বছর আগের৷ যেখানে বলা হচ্ছে প্রায় ৩৪ শতাংশ মহিলা সরাসরি বলছেন, পোশাকবিধি সরকার চাপিয়ে দিতে পারে না৷ এটা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে তো অধিকাংশ মহিলা হিজাবের পক্ষে!
ইরান আন্দোলনে বিদেশি ইন্ধন?
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে ইরানে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন৷ ইরান কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, সে আন্দোলনে বাইরে থেকে ইন্ধন ছিল৷
ছবি: Reuters
হতাশার বিক্ষোভ
২৮ ডিসেম্বর শুরু হয় আন্দোলন৷ মূলত কর্মহীনতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ধনী-গরিবের বিভাজনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তেহরানের রাজপথে৷ কিন্তু দ্রুত সেই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
গরিবের বিক্ষোভ
মূলত ইরানের গরিব মানুষেরা এই বিক্ষোভে যোগ দেন৷ দেশের সব প্রদেশ থেকেই দলে দলে মানুষ তেহরানে এসে ভিড় জমান৷ প্রদেশগুলিতেও বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
বিক্ষোভের মন্ত্র
আন্দোলনের নেতা কে, সে বিষয়ে ধন্ধে ছিল সরকার৷ রাজনৈতিক মহলের মতে এটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন৷ বিক্ষোভকারীরা দাবি করেন, ইরান সরকার লেবাননের হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করুক৷ সিরিয়া এবং ইরাকের রাজনীতিতে নাক গলানো বন্ধ করে বরং অভ্যন্তরীন বিষয়ে মন দিক ইরান সরকার৷
ছবি: twitter_arteshbood
বিক্ষোভ বিরোধিতা
বিক্ষোভের পাঁচদিনের মাথায় প্রথম মুখ খোলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি৷ অভিযোগ করেন, ‘ইরানের শত্রু’রা বিক্ষোভকারীদের হাতে অর্থ, অস্ত্র এবং আন্দোলনের নানাবিধ হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে৷ ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের স্থিতিশীলতা টলিয়ে দেওয়ার জন্যই এই কাজ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Anadolu Agency/Salampix
বিক্ষোভ দমন
বিক্ষোভ দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়৷ প্রায় ৪৫০ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে৷ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্ততপক্ষে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে৷ ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্বের পর ইরানের রাজপথ এত বড় বিক্ষোভ দেখেনি৷
ছবি: Getty Images/AFP
বিক্ষোভ আলোচনা
ইরানের বিক্ষোভ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ৷ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং অ্যামেরিকা ইরানের বিক্ষোভ এবং সরকারের ভূমিকার পক্ষে-বিপক্ষে মত প্রকাশ করে৷ রক্তক্ষয়ের বিষয়টি নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: dolatebahar
পাল্টা বিক্ষোভ
আন্দোলনের ১ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুলিশ ঘোষণা করে, আন্দোলন বন্ধ হয়েছে৷ আয়াতুল্লাহ খামেনির পক্ষেও বিশাল মিছিলের আয়োজন হয়৷ তবে বিভিন্ন প্রদেশে বিক্ষোভ এখনও অব্যাহত৷
ছবি: Reuters/Tasnim News Agency
7 ছবি1 | 7
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ধর্মীয় অনুশাসন যেখানে প্রবল সেখানে হিজাবের বিরুদ্ধে ৩৪ শতাংশ মহিলা প্রকাশ্যে কথা বলেছেন, এটাই অনেক৷ শুধু তাই নয়, তাঁদের বক্তব্য, এখন নতুন করে সমীক্ষা চালালে ৫০ শতাংশেরও বেশি মহিলা একই কথা বলবেন৷
যে সমীক্ষা ইরান সরকার প্রকাশ করেছে, সেখানে ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০১৪ সালের তুল্যমূল্য বিচার করা হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, এক দশক আগে সে দেশের মহিলারা হিজাবের পক্ষে ছিলেন৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরও মত বদলেছে৷ বলা হচ্ছে, ২০০৬ সালে ৫৪ শতাংশ মানুষ মনে করতেন মহিলাদের সবসময় গায়ে ও মাথায় চাদর জড়িয়ে রাখা উচিত, কিন্তু ২০১৪ সালে সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে৷
প্রশ্ন হলো, ইসলামিক আইনকে মান্যতা দিয়ে দেশ চালাচ্ছে যে সরকার, সেই সরকারের প্রধান কেন এই রিপোর্ট প্রকাশ করলেন? উত্তর জটিল৷ গত কয়েকমাস ধরে রুহানি বারে বারেই প্রমাণ করতে চাইছেন যে, তাঁর সরকার স্বচ্ছ৷ কোনো কিছুই সরকার গোপন করে না৷ এর আগে বাজেটের সম্পূর্ণ কপি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন তিনি৷ যার ফল ভালো হয়নি৷ দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে নির্দেশ করে জনগণ আন্দোলনে নেমেছিলেন৷ যার পরিণামে ২১ জনের মৃত্যুও হয়েছিল৷ সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, দেশের শত্রুরাই জনগণকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ রুহানির নতুন পদক্ষেপও আন্দোলনকারীদের আরো উৎসাহ দেবে না তো? ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারীরা বিষয়টিকে তাঁদের জয় হিসেবেই দেখছেন৷
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলছেন, মহিলাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যাতে বৃদ্ধি না পায়, তার জন্য ব্যবস্থা নেবে সরকার৷ হয়ত মেয়েদের দাবি আংশিক মান্যতাও পাবে৷ রুহানিও কিছুদিন আগে বলেছেন, জনগণের মতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তাঁর সরকার৷ তবে মেয়েদের হিজাব পরা বন্ধ হলে অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি তা কীভাবে দেখবে, সে প্রশ্নও একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ৷
এলিজাবেথ শুমাখার/এসজি
ইরানে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রোহানি
ইরানে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন হাসান রোহানি৷ চার কোটি ভোটার এবার ভোট দিয়েছেন৷ রুহানি পেয়েছেন ৫৭ ভাগ ভোট৷ অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ভোট৷
ছবি: Reuters/President.ir
প্রধান দুই প্রার্থী
ইরানে শুক্রবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়৷ নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি অন্যজন এবরাহিম রাইসি৷
ছবি: Mizan
ভোটার বেশি, তাই সময় বাড়ানো
শুক্রবার ভোটদানের সময় আরও পাঁচ ঘণ্টা বাড়ানো হয়৷ চলে স্থানীয় সময় মধ্যরাত পর্যন্ত৷ দেশটির ২০১৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রায় একই রকম ভোট পড়েছিল, ওই নির্বাচনে ব্যাপক জয় পেয়ে প্রথমবারের মতো ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মধ্যপন্থি প্রার্থী হাসান রোহানি৷
ছবি: Getty Images/M. Saeedi
সমস্যা থেকে উত্তোরণ
এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাইসির প্রতি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনেই সমর্থন জানানোয় অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন রুহানি৷ অবশেষে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সফল হলেন৷
রক্ষণশীল বলে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসি ভোটে কারচুপির অভিযোগ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Tima
নরমপন্থি রোহানি
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৬৮ বছর বয়স্ক হাসান রোহানি বাস্তববাদী ও অপেক্ষাকৃত নরমপন্থি বলে পরিচিত৷ আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রায় একঘরে হয়ে থাকা দেশটিকে অনেকটাই উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি৷ বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করায় ইরানের উপর অনেক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/D. Bockwo
পুনর্নির্বাচিত
রোহানিই প্রথমবার নন, সেই ১৯৮১ সাল থেকে ইরানে সব প্রেসিডেন্টই দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন৷