৪০ বছর আগে স্টার্ন ম্যাগাজিনের একটি 'আবিষ্কার' সারা দুনিয়াতে হইচই ফেলে দেয়। স্টার্ন হিটলারের ডায়েরি পেয়েছে বলে দাবি করে! এটিকে জার্মান গণমাধ্যমের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিজ্ঞাপন
সময়টা ১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল। হামবুর্গের গ্রুনার অ্যান্ড ইয়ার পাবলিশিং হাউস। এ যেন এক এলাহি কাণ্ড! স্টার্ন ম্যাগাজিন সবার সামনে যে আবিষ্কার উন্মোচন করবে তা দেখার জন্য ২৭ জন টেলিভিশন কুশলীসহ ২০০ এর বেশি সাংবাদিক হাজির হয়। হিটলারের ব্যক্তিগত ১২ টি কালো নোটবুক নিয়ে জনসমক্ষে আসেন ম্যাগাজিনটির সম্পাদক।
তারপর ডায়েরিগুলোর সাথে দাঁড়িয়ে স্টার্নের প্রতিবেদক গের্ড হেইডেমানের হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ছবিসহ চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানের প্রতিবেদনটি সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়।
ডায়েরির লিখা নিয়ে তিন দিন পরে একটি বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে স্টার্ন। শুধু এই ডায়েরি ছাপার জন্যই ম্যাগাজনটির ওই সংখ্যা কয়েক লাখ কপি বেশি বিক্রি হয়৷ বিশেষ ওই সংখ্যার জন্য অতিরিক্ত কিছু টাকাও গুণতে হয় পাঠকদের৷ ডায়েরি ছাপানোর পর স্টার্ন ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক পিটার কখ গর্বভরে লিখেন, থার্ড রাইখের বড় অংশই নতুন করে লিখতে হবে৷
হিটলারের বিরোধিতা করা নায়কেরা
১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসেন আডল্ফ হিটলার৷ তাঁর কার্যক্রমের বিরোধিতা করে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন, অনেককে দেশও ত্যাগ করতে হয়েছে৷ কেউ কেউ হিটলারকে হত্যার চেষ্টাও করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
হত্যা চেষ্টা
হিটলারকে হত্যা করতে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই তাঁর ‘ওল্ফস লেয়ার’ সদরদপ্তরে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল৷ কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে বৈঠক করে ফেলায় বোমা ফাটলেও বেঁচে গিয়েছিলেন হিটলার৷ তবে চারজন নিহত হয়েছিলেন৷ হামলার সঙ্গে কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন৷ পরবর্তীতে চাঁদের ফাঁসি দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
নেপথ্যে যিনি ছিলেন
ওল্ফস লেয়ারে হিটলারকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন ছিলেন ক্লাউস গ্রাফ শেঙ্ক ফন স্টাফেনব্যার্গ৷ ১৯৪২ সালে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জার্মানির পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়৷ তাই জার্মানিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি হিটলার সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দ্য ক্রাইসাউয়ার সার্কেল
জার্মান রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে ‘ক্রাইসাউয়ার সার্কেল’ গঠন করা হয়েছিল৷ হেলমুট জেমস গ্রাফ ফন মল্টকে এবং পেটার গ্রাফ ইয়র্ক ফন ভার্টেনবুর্গ (ছবি) এই আন্দোলনের পেছনের মূল মানুষ ছিলেন৷ ‘ক্রাইসাউয়ার সার্কেল’-এর কয়েক কর্মীও ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই হিটলার হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ তাঁদেরও পরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
ভাই-বোন
হান্স ও সোফি শোল - এই দুই ভাই-বোনের নেতৃত্বে ১৯৪২ সালে মিউনিখের একদল শিক্ষার্থী হিটলার সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন৷ ‘হোয়াইট রোজ’ নামে গড়ে তোলা তাঁদের গ্রুপ নাৎসি আমলের অপরাধের সমালোচনা করে হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করেছিল৷ ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই দুই ভাই-বোনকে গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কাঠমিস্ত্রি গেওর্গ এলসার
১৯৩৯ সালে মিউনিখে এক জায়গায় হিটলারের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল৷ সেখানে একটি বোমা রেখেছিলেন এলসার৷ তবে যখন বোমাটি ফেটেছিল ততখনে বক্তব্য শেষ করে ঐ জায়গা থেকে চলে গিয়েছিলেন হিটলার৷ তবে বোমা বিস্ফোরণে সাতজন প্রাণ হারিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন ৬০ জন৷ এলসারকে সেদিনই গ্রেপ্তার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ ১৯৪৫ সালে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Images
শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ
হিটলার ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী তার প্রতিবাদ করেছেন৷ পরবর্তীতে তাঁদের অনেককে ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে৷ ছবিতে বার্লিনের ক্যাবারে গোষ্ঠী ‘কাটাকম্বে’র সদস্যদের দেখতে পাচ্ছেন৷ তারাও হিটলার প্রশাসনের বিরোধিতা করেছিলেন৷ ফলে ১৯৩৫ সালে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ভ্যার্নার ফিঙ্ককে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance / akg-images/J. Schmidt
তরুণদের প্রতিবাদ
হিটলার আমলে জার্মান তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রের জীবন যাপন রীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন৷ তাঁরা সুয়িং ড্যান্স ও সংগীতের ভক্ত ছিলেন৷ এই তরুণরা ‘ডি সুয়িং ইয়োগেন্ড’ বা সুয়িং ইয়থ নামে একটি গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন৷ তারাও বিভিন্ন সময় নাৎসি আমলের বিরোধিতা করেছেন৷ ফলে তাঁদের অনেককে গ্রেপ্তার করে তরুণদের জন্য গড়ে তোলা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/Hulton/Keystone
রেড অর্কেস্ট্রা গ্রুপ
নাৎসি শাসকদের অপরাধের তালিকা তৈরি করতে ইহুদিদের সহায়তা করত ‘রটে কাপেলে’ গ্রুপ৷ এসব তারা লিফলেট আকারে বিতরণও করতো৷ এ কারণে ১৯৪২ সালে এই গ্রুপের ১২০-এর বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ এর মধ্যে পঞ্চাশের বেশি ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
8 ছবি1 | 8
ডায়েরিটা ছিল ব্যক্তিগত বিষয়ের বয়ান৷ অনেকটা এরকম, হিটলারের বান্ধবী ইভা ব্রাউন ১৯৩৬ সালে অলিম্পিকের টিকিট বিনামূল্যে চেয়েছিলেন, বিষয়টা তাকে বিরক্ত করেছিল। ইভা আরও চেয়েছিলেন যে হিটলার তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য যেন একজন ডাক্তারের কাছে যান। "ইভার অনুরোধে আমি ডাক্তারদের পরীক্ষায় রাজি হয়েছিলাম। নতুন বড়িগুলিতে আমার পেটে সমস্যা হচ্ছিল এবং ইভার দাবি মতে, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করছিল।"
অনেক ইতিহাসবিদ ও অন্য গণমাধ্যমের সহকর্মীরা লেখাগুলো সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা সেগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করেননি। ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ অফিসও বিশেষজ্ঞ মতামত উপস্থাপন করলে, জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। ডায়েরিগুলোর কাগজ হিটলারের অর্থাৎ থার্ড রাইখের সময়ের ছিল না, এসব কাগজের উদ্ভব ১৯৫০ সালের পরে৷ এরপর পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস তদন্ত শুরু করে।
প্রতিবেদক গের্ড হেইডেমান, জালিয়াতি ও ডায়েরি তৈরিতে সহযোগী ইলাস্ট্রেটর কনরাড কুয়াউের পরিণতি গড়ায় কারাগারে। কুজাউ ২০০০ সালে ক্যান্সারে মারা যান আর হেইডেমান এখন হামবুর্গে আছেন। স্টার্ন পরে অবশ্যই এই কেলেঙ্কারিকে তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে। বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাদের কয়েক বছর লেগে যায়।