শুধু শিবমন্দিরে পুজো দেওয়াই নয়, মঙ্গলবার নন্দীগ্রামের জনসভায় ভাষণ দেয়ার আগে-পরে তিনি গোটা তিনেক মন্দির, একটি মাজারে যান। আর জনসভায় তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে চণ্ডীপাঠ করেন। মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী সহ অনেক দেবদেবীর নাম করেন। তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মীয় আচার আচরণের সঙ্গে তার পুরোদস্তুর পরিচয় আছে। তিনি সমাবেশে উপস্থিত মানুষকে বলেন, ''ধর্ম নিয়ে খেলা হবে? লক্ষ্মীমন্ত্র, জগন্নাথমন্ত্র, জগদ্ধাত্রীমন্ত্র হবে?''
এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বের তাস খেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ''যারা ৩০-৭০ করছে তাদের একটু শুনিয়ে দিই। হিন্দু ধর্ম নিয়ে আমার সঙ্গে কম্পিটিশন করুক।'' তারপর মমতার বক্তব্য, ''হিন্দু ধর্ম আমাকে শেখাচ্ছেন? কোনটা চান? চণ্ডীপাঠ করে বাড়ি থেকে বের হই। আমাকে হিন্দুধর্ম শেখাচ্ছে?'' ৩০-৭০ মানে পশ্চিমবঙ্গে ভোটদাতাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মুসলিম এবং ৭০ শতাংশ হিন্দু।
এর আগে বিজেপি-র হিন্দুত্বের মোকাবিলা করতে নরম হিন্দুত্বের পথে হেঁটেছিলেন রাহুল গান্ধী। তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। মন্দির দর্শন করে ভাষণ দেয়ার কৌশল উত্তর প্রদেশে কাজ দেয়নি। অন্য বেশ কয়েকটি রাজ্যেও নয়। কিন্তু দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল নরম হিন্দুত্বের পথে চলে বিজেপি-র কৌশল বানচাল করে দিয়েছিলেন। ফলে এই পথে বিজেপি-র মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতা দুইই আছে।
মমতার ক্ষেত্রে কী হতে পারে? প্রবীণ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, মমতাকে এই পথে হাঁটতেই হতো। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, মমতার এছাড়া উপায়ও নেই। বিজেপি যেভাবে চড়া হিন্দুত্বের পথে চলছে, তার মোকাবিলা করতে হতো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দলের মতে, মুসলিম ভোটের সিংহভাগ আগের মতো তাদের কাছেই আসবে। বিজেপি খুব সচেতনভাবে মমতাকে মুসলিমদের দিকে ঠেলে দিয়ে হিন্দুদের ভোটের সিংহভাগ পেতে চাইছে। জয় শ্রীরাম, রামনবমী, প্রকাশ্যে হিন্দুত্বের বড়াই সে জন্যই। মমতাকেও তাই প্রমাণ করতে হচ্ছে, তিনি হিন্দু বিরোধী নন।
পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে লড়ছেন মমতা
আগামী ২৭ মার্চ থেকে আট পর্বের বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে। কেমনভাবে লড়ছেন গত দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Prabhakarmani Tewari/DW
মমতাই প্রথম
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই ২৯১টি কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। পাহাড়ের তিনটি আসন ছেড়ে দিয়েছেন শরিক গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে। বিজেপি ও বাম জোট প্রথম দুই দফার প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে তিনি বাকিদের থেকে এগিয়ে রইলেন।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
বাদ ৬৪ জন বিধায়ক
এবার কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। গতবারের ৬৪ জন বিধায়ককে এবার আর প্রার্থী করেননি তৃণমূল-সুপ্রিমো। তাদের কেউ বিজেপি-তে গেছেন। অন্যরা জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। সবমিলিয়ে গতবারের তুলনায় শতাধিক প্রার্থী বদল করেছেন মমতা। নেতাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকলে তাকে আর প্রার্থী করা হয়নি। ৮০ বছরের বেশি বয়সীরা বাদ পড়েছেন। তাই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ভোটে লড়ছেন না। উপরের ছবিটি বাজেট পেশ করার সময় অমিত মিত্রর।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নতুন কেন্দ্রে মমতা
মুখ্যমন্ত্রী নিজে লড়ছেন নতুন কেন্দ্র নন্দীগ্রামে। তার আগের কেন্দ্র ভবানীপুরে নয়। বিজেপি-তে যোগ দেয়া তার একদা লেফটন্যান্ট শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ ভোঁতা করে দিতে তিনি এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১০ মার্চ তিনি মনোনয়নপত্র পেশ করবেন। নন্দীগ্রামে ইতিমধ্যে বড়সড় জনসভা করেছেন মমতা।
ছবি: DW
কম মুসলিম প্রার্থী
গতবারের তুলনায় এবার তৃণমূলে মুসলিম প্রার্থীদের সংখ্যা কম। তৃণমূল এবার ৪৭ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। গতবার দিয়েছিল ৫৭ জন। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের অভিযোগ, হিন্দুরা ক্ষুব্ধ বুঝে মুসলিম প্রার্থী কমিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট আছে।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
প্রচার মমতাময়
তৃণমূলের প্রচার মমতাময়। মুখ্যমন্ত্রী সবকটি কেন্দ্রে প্রচারে যাবেন। জনসভা করবেন। পদযাত্রাও। ইতিমধ্যে কলকাতা ও শিলিগুড়িতে পদযাত্রা করে ফলেছেন। তাই নন্দীগ্রামে তিনি বেশি সময় দিতে পারবেন না, তা আগেই জানিয়ে এসেছেন। সেখানে তার ভোটের দায়িত্বে পূর্ণেন্দু বসু।
ছবি: DW/Sirsho Bandopadhyay
আক্রমণাত্মক প্রচার
বিজেপি-র প্রধান দুই নেতা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ যে অভিযোগ করবেন, তার জবাব দেয়ার কৌশল নিয়েছেন মমতা ও তার ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। বিজেপি এবার প্রচারে অভিষেককে টার্গেট করেছে। মমতা তার জবাব দিয়েছেন। পাল্টা টেনে এনেছেন অমিত শাহের ছেলে জয় শাহের প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রীকেও আক্রমণ করেছেন।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
প্রচারের ভাষা
আক্রমণ করতে গিয়ে অনেক সময়ই ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না তৃণমূল নেতাদের। মোদী-শাহকে হোঁদলকুতকুত ও কিম্ভূতকিমাকার বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তিও উঠেছে।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
আমল দিচ্ছে না তৃণমূল
অনেকে প্রার্থী হতে পারেননি। অনেকে বাদ পড়েছেন। তা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তুঙ্গে। আরাবুল ইসলাম, সোনালি গুহরা প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছেন। তবে এই ক্ষোভ আমল দিতে চাইছেন না মমতা। তিনি এখন নেমে পড়েছেন ভোটের ময়দানে। শুধু একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আবার জিতলে তিনি বিধান পরিষদ বানাবেন। বেশ কিছু নেতাকে বিধান পরিষদের সদস্য করা হবে।
ছবি: Getty Images/D. Sarkar
পিকে-র কৌশল
তৃণমূলের ভোট কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-র। তিনি একদিকে সামাজিক মাধ্যমে তৃণমূলকে খুবই সক্রিয় করেছেন। অন্যদিকে কীভাবে বিজেপি-র প্রচারের জবাব দিতে হবে, তার পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রার্থীদের বিষয়ে একের পর এক সমীক্ষা করেছেন। দুর্নীতি ও অন্য অভিযোগ নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কমানোর জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ছবি: Hindustan Times/Imago Images
কঠিন লড়াই
এবার কঠিন লড়াইয়ের মুখে মমতা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিজেপি। ফলে পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোট খুবই চিত্তাকর্ষক হবে। মমতার সামনেও লড়াই রীতিমতো কঠিন।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
সৌম্যের মতে, মমতা আগে থেকেই এই চেষ্টাটা করছেন। তিনি ইমাম-ভাতা চালু করেছেন, সেই সঙ্গে পুরোহিত ভাতাও। দুর্গাপুজোয় ক্লাবগুলিকে অর্থসাহায্য করছেন। কিন্তু আরেক প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তার মতে, মমতার উচিত ছিল তার আগে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতার রাস্তায় থাকা। রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে, সন্তদের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়েও বিজেপি-কে আটকাতে পারেননি। মমতাও এভাবে হিন্দুত্বের পথে হাঁটলে তাতে বিজেপি-র সুবিধা। কারণ, খেলাটা তখন তাদের পিচে হবে। ভারতজুড়ে বিজেপি প্রমাণ করে দিয়েছে, এই পিচে তারা প্রায় অপ্রতিরোধ্য।
তবে সৌম্য মনে করেন, মমতা যে ভোট পান, সেটা মূলত গ্রামের গরিব মানুষ, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের। তাদের জন্য তিনি ঢালাও সামাজিক প্রকল্প নিয়েছেন। তার উপর বিজেপি-র হিন্দুত্বের প্রচার ভোঁতা করতে তিনিও হিন্দুত্বের তাস খেলছেন।
এতে মমতা এবং তৃণমূলের লাভ না ক্ষতি সেটা ফলাফল বেরনোর পর বোঝা যাবে, আপাতত ঘটনা এটাই, নন্দীগ্রামে গিয়ে দুই দিন ধরে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় সমানে হিন্দুত্বের তাস খেলে গেলেন।