হিন্দুদের প্রতি শেখ হাসিনার অনুরোধ ও বিপরীত বাস্তবতা
১৯ আগস্ট ২০২২তাদের কথা, ‘‘সংবিধানে যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় তখন অন্যান্য ধর্ম গৌণ হয়ে যায়৷’’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ‘‘এই মাটিতে আপনাদের সমান অধিকার৷ আমার যতটুকু অধিকার, আপনাদেরও সেই অধিকার৷ এভাবে সকলেরই সমান অধিকার আছে৷ কাজেই এখানে আপনারা কখনোই নিজেদেরকে সংখ্যালঘু বা ওই রকম মনে করবেন কেন?’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আপনারা মনে করবেন আপনারা এই দেশেরই নাগরিক৷ সমানভাবে নাগরিক অধিকার আপনারা ভোগ করবেন এবং আমরা সেইভাবেই আপনাদেরকে দেখতে চাই৷কখনো নিজের ভেতর ওই হীনমন্যতা নিয়ে আসবেন না বা নিজেদেরকে আলাদা কিছু ভাববেন না৷’’
‘আমাদের সাংবিধানিক সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘পাকিস্তান আমলে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয়ভাবেই আমাদের সংখ্যালঘু করে রাখা হয়েছিল৷ সংবিধানে বলা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা হলো রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত৷ কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধর্মীয় বা জতিগত সংখ্যালঘু থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি৷ তাই সেভাবেই ৭২-এর সংবিধান রচনা করা হয়েছিল৷ কিন্তু যখন সেই সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হলো, তখন আমরা ফের সংখ্যালঘু হয়ে গেলাম৷ সেটা এখনো আছে৷ এখন আমরা চাই বা না চাই বাংলাদেশে মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের লোকেরা সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সবাই আইনের চোখে সমান- সংবিধানে এই কথা লেখা থাকলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মধ্য দিয়ে আমাদের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে৷ এর সমাধান হলো ৭২-এর সংধিানে পুরোপুরি ফিরে যাওয়া৷’’
তিনি অনেকটা আক্ষেপ এবং হতাশা নিয়েই বলেন, ‘‘আমাদের প্রতি সমান আচরণও করা হয় না৷ সেটা হলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রয়োজন হতো না৷ আমরা তো সংখ্যালঘু থাকতে চাই না৷’’
‘আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে’
তবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন৷ রাষ্ট্রের নাগরিক কেউ সংখ্যালঘু হতে পারে না৷ তারপরও তার কথা, ‘‘আমরাও নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবি না৷ আমরা সংখ্যালঘু সহওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি৷ কিন্তু আমরা দেখি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের সংখ্যালঘু হিসেবে অভিহিত করছে৷ তারা বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকবে৷ আমাদেরকে সংখ্যালঘু ভাবার একটি মাইন্ডসেট এখানে তৈরি হয়েছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন কল্যাণ ট্রাস্ট আছে৷ সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ হয়৷ অন্য ধর্মের জন্যও জনসংখ্যা অনুপাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ তাছাড়া ৭২-এর সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে৷”
চন্দ্রনাথ পোদ্দার আরো বলেন, ‘‘তোমরা সংখ্যালঘু, তোমাদের আমরা দেখভাল করবো- এই কথার মধ্য দিয়েই আমাদের হেয় করা হয়৷ আমরা তখন হীনমন্যতায় ভুগি৷’’
‘রাষ্ট্রের আচরণেও আমরা সংখ্যালঘু’
অমুসলিমদের নেতাদের অনেকেই মনে করেন, রাষ্ট্রের আচরণ এবং ভূমিকাও তাদের সংখ্যালঘু করে রেখেছে৷ বিশেষ করে তাদের ওপর নানা অজুহাতে হামলা এবং তার বিচার না হওয়ার বিষয়গুলো এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে তারা মনে করেন৷ তারা মনে করেন, হামলার সময় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায়ও প্রমাণ হয় যে মুখে যা-ই বলা হোক না কেন তাদের আসলে সংখ্যালঘু হিসেবই দেখা হচ্ছে৷ বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশনের এক্জিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট অশোক বডুয়া বলেন, ‘‘রামুতে হামলার সময় আমরা দেখেছি সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা হামলাকারীদের বলেছেন- আমার গায়ে পুলিশের পোশাক না থাকলে আমিও আপনাদের সঙ্গে অংশ নিতাম৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই যে ট্রাইবালরা আছি, তারা বাংলাদেশে সমান অধিকার পাচ্ছি না৷ শহরে হয়ত আমরা ভালো আছি, কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা প্রতিবেশীদের হুমকির মুখে থাকি৷ রাষ্ট্রধর্ম যদি ইসলাম থাকে, তাহলে তো আমরা সংখ্যালঘুই হয়ে যাই৷ আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ আমার স্বপ্ন ছিল সবার মতো আমাদেরও একই অধিকার থাকবে৷’’
তার মতে, ‘‘এখন সরকারে উচিত হবে মাইনরিটি রাইট কমিশন করে তাদের অধিকার আগে নিশ্চিত করা৷ কেউ সংখ্যালঘু নয়, এটা বলে বৈষম্য দূর করা যাবে না৷’’
‘তাদের দুর্বল করা হয়েছে’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘তাদের সাথে যে আচার-আচরণ করা হয়, যেভাবে হামলা করা হয়, তাতে তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন না৷ ফলে তারা নিজেদের সংখ্যালঘু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তবে মূল কথা হলো, সংবিধানে যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হলো তখন সংবিধানকে একটি ধর্মীয় লেবাস পড়িয়ে অন্য ধর্মকে আলাদা করা হলো৷ ওই সব ধর্ম আর সমান মর্যাদায় থাকলো না৷ ফলে তারা নিজেদের সংখ্যালঘুর কাতারেই দেখতে পেলো৷ তাদের দুর্বল করা হলো বা তারা নিজেদের দুর্বল ভাবতে শুরু করলো৷’’