হিন্দু জাতীয়তাবাদের কারণে জার্মান শিক্ষা বাতিল: স্পিগেল
২৩ অক্টোবর ২০১৪
ভারতের স্কুলে জার্মান ভাষা শেখানোর একটি কর্মসূচির মেয়াদ না বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের ঘটনা জার্মানিতেও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে৷ জার্মান কূটনীতিকরা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর সাধারণত জার্মান সংবাদ মাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায় না৷ কিন্তু ‘ডেয়ার স্পিগেল' পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে একটি খবর এমনই একটি সফরকে নতুন মাত্রা দিয়েছে৷ না, কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে হইচই পড়ে যায় নি, আগ্রহের কারণ ভারতের কিছু স্কুলে জার্মান ভাষা শিক্ষার একটি কর্মসূচিকে ঘিরে৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ার-এর নতুন দিল্লি সফরের ঠিক পরেই ভারত সরকার এই কর্মসূচি বাতিল করেছে৷
জার্মানির ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারের ক্ষেত্রে সক্রিয় গ্যোটে ইনস্টিটিউট – ভারতে যার শাখাগুলি মাক্স ম্যুলার ভবন নামে পরিচিত৷ ২০১১ সালে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠান ভারতে এক প্রকল্প শুরু করেছিলো৷ লক্ষ্য, ভারতের ১,০০০টি ‘কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়' স্কুলে প্রথম বিদেশি ভাষা হিসেবে জার্মান শেখানো৷ এর জন্য জার্মান সরকার বছরে প্রায় ৭ লক্ষ ইউরো ব্যয় করে এসেছে৷ এর আওতায় জার্মান ভাষা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে৷ ২০১৩-২০১৪ সালের শিক্ষাবর্ষে ৭০০টি স্কুলে প্রায় ১ লক্ষ ছাত্রছাত্রী জার্মান ভাষা ক্লাসে যোগ দিয়েছে৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
স্টাইনমায়ার গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তাঁর ভারত সফরে সরাসরি এই কর্মসূচির সাফল্যের স্বাদ পেয়েছেন৷ নতুন দিল্লির একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তিনি প্রায় দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে তাদের জার্মান ভাষা জ্ঞান ও জার্মানি সম্পর্কে তাদের আগ্রহের পরিচয় পেয়েছেন৷
এমন সাফল্যের পর জার্মান সরকার এই কর্মসূচির মেয়াদ আরও ৩ বছর বাড়াতে চেয়েছিলো৷ কিন্তু ভারত সরকার এর বিরোধিতা করেছে বলে জানিয়েছে ‘স্পিগেল অনলাইন'-এর প্রতিবেদন৷
জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এখনো হাল ছাড়তে প্রস্তুত নয়৷ মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র অনুযায়ী, এই সফল কর্মসূচি যাতে চালিয়ে যাওয়া হয়, সেই প্রচেষ্টা চালু থাকবে৷ ভারতের স্কুলগুলিতে জার্মান ভাষাকে ঘিরে বিপুল উৎসাহ দেখা গেছে৷ শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জার্মান ভাষার প্রসারে সহায়তা করতে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়ে চলেছে৷ ভারতে এই কর্মসূচির ক্ষেত্রে জার্মানির শিল্প-বাণিজ্য জগতেরও বেশ উৎসাহ দেখা গেছে৷ কারণ ভবিষ্যতে দক্ষ কর্মীর অভাব পূরণ করতে ভারতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তাদের আশা রয়েছে৷
‘স্পিগেল অনলাইন'-এর সূত্র অনুযায়ী ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাবই এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ৷ ফলে বিদেশি ভাষার প্রসারের বিষয়টি ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না৷ সংস্কৃত ভাষা প্রসারে আগ্রহী একটি সংগঠন সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিদেশি ভাষার বদলে ভারতের ভাষাগুলি প্রসারের পক্ষে সওয়াল করেছে৷ অনেকে মনে করছেন, এমন প্রেক্ষাপটেই জার্মান ভাষা কর্মসূচি বাতিল করেছে সরকার৷ তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসন অর্থনৈতিক উন্নতি ও বিদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তার আওতায় বিদেশি ভাষা শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে আশা করেছিলেন জার্মান কূটনীতিকরা৷