জামায়াত-শিবির সমর্থকদের হামলায় ভাই নিহত৷ বিচার চান সাজু মিয়া৷ হবে বিচার? কবে? কে করবে? বিচারপ্রার্থী হয়ে সাজুর জীবনই বিপন্ন৷ আসামী ধরায় পুলিশের তৎপরতা নেই৷ শত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সাজুর প্রাপ্তি শুধু কান্না৷
ছবি: Shayantani Twisha
বিজ্ঞাপন
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চা দোকানদার সাজু মিয়া ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে সত্যি সত্যিই কেঁদেছেন৷ তাঁর কষ্ট, বেঁচে থাকার নীরব যুদ্ধ, মৃত ফুপাতো ভাই শরিফুলের বিচার চেয়ে ডেকে আনা বিপদে নিজেকে একাকী দেখার বেদনা –এসব যে কেউ একজন শুনতে চেয়েছেন সাজু তাতেই অভিভূত৷ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে পুলিশকে পাননা পাশে, আওয়ামী লীগ কর্মী হয়ে দল ক্ষমতায় থাকতেও দেখেন দলীয় নেতাদের উদাসীনতা, স্বার্থপরতা এবং অসহায়ত্ব৷ হামলাকারীরা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে, সাজু থানায় গেলে কিংবা নিজের দোকান খুলতে গেলেও আসে বাধা, আসে হত্যার হুমকি৷ সহানুভূতি নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করার আশ্বাসটুকুও কেউ দিলে তো!
‘হিন্দু’ মরে ভয়ে, ‘মুসলমান’ প্রাণভয়ে
This browser does not support the audio element.
সুন্দরগঞ্জ থানার পুলিশ কখনো দেয় মিথ্যা আশ্বাস, রাত দুটো পর্যন্ত থানায় অপেক্ষা করেও আশ্বাসে বিশ্বাস হারিয়ে ফিরে আসতে হয় সাজুকে, কখনো কনস্টেবলের কণ্ঠে ঝরে অসহায়ত্ব, মনে করিয়ে দেয়া হয় – পুলিশেরও পরিবার থাকে, পরিবারের জন্য তাঁদেরও বেঁচে থাকতে হয়! কখনোবা এজাহারভুক্ত আসামী না ধরে ধরে আনা হয় নিরীহ কোনো মানুষ৷ বিচারপ্রার্থী সাজু দিশেহারা৷ গিয়েছিলেন গ্রাম কমিটির আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে৷ সভাপতি হিন্দু৷ তিনি দলীয় কর্মীকে সহযোগীতা করবেন কী, সাহস জোগাতেও ব্যর্থ৷ ‘ঠুঁটো জগন্নাথ' সভাপতি বলেন, ‘‘আমার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিল, মামলা করার সাহস পেলাম না, তোমার জন্য কী করব বলো!''
যাঁরা কিছু করতে পারেন তাঁদের টিকিটির নাগাল পাওয়ার সাধ্য সাজুর মতো খেটে খাওয়া অতি সাধারণের অন্তত নেই৷ কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছিলেন ঘটনার পরপর৷ কথায় ছিল মন ছুঁয়ে যাওয়া আন্তরিকতা, দিয়ে গেছেন সুবিচারের আশ্বাস, কেউ কেউ নিজের হাতখরচের টাকাটাও গুঁজে দিয়েছেন সাজুর হাতে৷ সবচেয়ে বেশি ‘দানশীল' সরকার৷ ২০ হাজার টাকা আর ৫০ কেজি চাল পাওয়ার কথা তাই কৃত্জ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন সাজু৷ এ সাক্ষাৎকারে জামায়াত-শিবির সমর্থকদের আক্রমণের শিকারদের পাশে দাঁড়ানো সংগঠন ‘আমরা'-র দেয়া ৩০ হাজার টাকারও প্রাপ্তি স্বীকার করতে ভুল হয়নি সাজুর৷ কিন্তু তিন মাসে এই প্রাপ্তিতে তো সংসার চলে না৷
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
সাজু মিয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে মনে হতে পারে, হয়ত জামায়াত-শিবির কর্মীদের মুখোমুখি হতে গিয়েই তাঁর জীবনে এই বিপর্যয়৷ ঘটনা একেবারে অন্যরকম৷ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যেদিন ফাঁসির আদেশ দেয় সেদিন ঘর থেকেই বেরোননি৷ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেদিন ১০-১৫ হাজার উন্মত্ত মানুষ নির্বিচারে পুড়িয়েছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, সরকারি সম্পদ, মেরেছে পুলিশ, প্রাণ দিতে হয়েছে শিবির কর্মীদেরও৷ সাজু দুই ভাই আর কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিয়ে তছনছ হওয়া বাজারে গিয়েছিলেন পরের দিন৷ নিজের দোকানের অবস্থাটা না দেখে আর পারছিলেন না৷ দোকানের কাছে যেতেই হামলা৷ দৌড়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি৷ ধাওয়া করে মারা হয় তাঁদের৷ ফুপাতো ভাই শরিফুল মারা যায় চোখের সামনে৷ সাজু আর তাঁর বড় ভাই ফুল মিয়া আহত হয়ে যান হাসপাতালে৷ সেখানেও মৃত্যুআতঙ্ক৷ থেকে থেকে হত্যার হুমকি৷ চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখেই ফিরতে হয় বাড়িতে৷
বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলার সময় সাজু জানান, বড় ভাইয়ের ভাঙা হাত এখনো সারেনি৷ নিজে তখন জ্বরে কাঁপছেন৷ অসুস্থ শরীর নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেয়ায় কৃতজ্ঞতা জানাতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন৷ কাঁদতে কাঁদতেই জানান সাংবাদিকের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করার৷
যেখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয়, সরকার নিরুদ্বিগ্ন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হিন্দু বলে জামায়াত-শিবিরের আক্রমণে প্রায় সর্বস্ব হারিয়েও মামলা করতে ভীত, সাংবাদিক সেখানে কতটা সক্ষম?