লাভ জিহাদের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে ভারতে৷ সংস্কৃতিমনস্ক, প্রগতিশীলদের অঞ্চল হিসাবে পরিচিত বাংলাতেও তার নমুনা মিলছে৷ এমন নজির অবশ্য একরযুগ আগেও ছিল
বিজ্ঞাপন
উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে ভিন্ন ধর্মে বিবাহিত যুগলদের মাঝেমধ্যেই লাভ জিহাদের দায়ে পুলিশি জুলুমের মুখে পড়তে হয়৷ একাধিক গ্রেপ্তারি ইতিমধ্যেই হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে এখানেও সেই আইন কার্যকর করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক নরোত্তম মিশ্র৷ তবে তার আগেই পশ্চিমবঙ্গে দেখা যাচ্ছে তার ইঙ্গিত৷
দক্ষিণবঙ্গের হুগলি জেলার শহরতলির একটি লজে ঘরভাড়া নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন চিত্রশিল্পী তৌসিফ হক ও তার স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস৷ সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যই বিষয়টি সকলের নজরে আসে৷
শুভজিৎ রায়
কী ঘটেছিল?
স্বামী-স্ত্রীর পদবী আলাদা৷ তার জেরেই হুগলির সদর শহর চুঁচুঁড়ায় একটি লজে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে জায়গা পাননি বর্ধমানের বাসিন্দা তৌসিফ৷ তিনি ফেসবুকে দাবি করেছেন, ‘‘আমাদের কাছে ভোটার, আধার, প্যান কার্ড সবই ছিল৷ তা-ও ঘর দেওয়া হয়নি৷’’ সঠিক পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও কেন তৌসিফ ঘর পেলেন না? লজ পরিচালকদের দাবি, ওই দম্পতি নথি দেখাতে চাননি৷ তৌসিফ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘পিকনিকে বিয়ের সার্টিফিকেট কে নিয়ে যায়? শুধু পিকনিকে কেন, যেখানেই যাই মানিব্যাগে এক কপি জেরক্স ও ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে রেখে দিই৷ কারণ, এর আগেও অনেক জায়গায় সার্টিফিকেট দেখতে চেয়েছে৷ কারণটা শুধু ভিন্ন ধর্ম নয়, দুটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েকে অনেক জায়গাতেই রুম দেওয়া হয় না৷’’
বিষয়টি নিয়ে তৌসিফ প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে চাননি৷ শিল্পীর বক্তব্য, তারা আইনত স্বামী-স্ত্রী৷ স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে তাদের বিয়ে হয়েছে৷ সেই সার্টিফিকেট দেখানোর পরেও ঘর দেওয়া হয়নি৷
কী বলছেন অন্যরা?
ঘর ভাড়া নেওয়ার জন্য নথি দেখানোর রেওয়াজ তৈরির বিষয়ে আইনজীবী অঙ্কন বিশ্বাস বলেন, ‘‘এটা অত্যাবশ্যকীয় নয় যে কোথাও বিবাহিতরা থাকলেই তাদের বিয়ের নথি দেখাতে হবে৷ আপনি প্রাপ্তবয়স্ক হলে কোথায় কাকে নিয়ে গেলেন, সেটা নিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ নাক গলাতে পারেন না৷ কিন্তু সাধারণভাবে তারা নাক গলান পুলিশি ভয়ে৷’’
সুহৃতা সাহা
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা সুহৃতা সাহা এই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট আছে৷ দেশে আইন যখন আছে, বাকি জিনিসগুলি অমূলক৷’’ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘আমাদেরও এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে৷ স্বামীর পদবি ব্যবহার না করার দরুণ আমার আলাদা পদবী ছিল৷ তাই ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছাড়া ঢুকতে দেবে না বলা হয়েছিল৷ এসব খুবই নিন্দনীয়৷ প্রাপ্তবয়স্ক যুগলকে একসঙ্গে থাকতে কেউ বাধা দিতে পারে না৷’’ এটা শুধু ধর্মান্তরকরণ-বিরোধী লাভ জিহাদের বিষয় না-ও হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি৷
দুবরাজপুর মহকুমা হাসপাতালের ডাক্তার শুভজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী নাজমা খাতুনের ১০ বছর আগেই হয়েছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ কলকাতার নিকটবর্তী শহরতলিতে ২০০৮ সালেও এই দম্পতি বসবাসের জন্য কোনো ঘরভাড়া পাননি৷ বাড়ির মালিকরা হিন্দু স্বামীর মুসলিম স্ত্রী পরিচয় দেখেই বাড়িভাড়া দিতে আপত্তি করেন৷ ডয়চে ভেলেকে সে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে নাজমা বলেন, ‘‘ডাক্তার রায় একা গিয়ে বাড়ি ভাড়া ঠিক করে আসতেন৷ কিন্তু পরে আমি গেলেই আমার নাম শুনে, শাঁখাসিঁদুর না দেখতে পেয়ে বাড়িভাড়া দেওয়া হতো না৷ প্রকাশ্যে তারা বাড়িভাড়া না দেওয়ার কারণ দেখাতেন না৷ বেশ কয়েকবার এই অভিজ্ঞতার মুখে আমরা পড়েছি৷’’ তৌসিফ ও জয়ন্তীর ঘটনা শুনে এই দম্পতি সেই অতীতকেই রোমন্থন করছেন যেন৷ শুভজিৎ বলেন, ‘‘ব্যাপারটা খুবই ভয়ের৷ সুশিক্ষিত নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে সমাজের এই বিষময় প্রভাব কাটাতে৷ সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতাটুকু প্রাপ্তবয়স্কদের মৌলিক অধিকার নয় কি?’’ এই ঘটনার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা যেমন বিরক্তি দেখিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন চুঁচুড়ার ওই লজের সামনে বিক্ষোভও জানিয়েছে৷
ভারতীয় সংস্কৃতির ১০ তথ্য
‘নমস্তে’ থেকে শুরু করে বিয়ের বিশাল আয়োজন এবং পবিত্র প্রাণী হিসেবে গরুর অবস্থান, ভারতের সংস্কৃতির এমন কিছু মজার তথ্য ও এর পেছনের কারণ নিয়ে ডয়চে ভেলের এই ছবিঘর৷
ছবি: Tumpa Mondal/picture-alliance/Photoshot
সিন্ধু সভ্যতা
ইন্ডিয়া নামটি এসেছে মূলত ইন্দাস বা সিন্ধু নদী থেকে৷ অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু উপত্যকায় এ সভ্যতা গড়ে ওঠে৷ উপত্যকার স্থানীয় বাসিন্দাদের বলা হতো সিন্ধু৷ পারস্য সাম্রাজ্যের যোদ্ধারা সিন্ধু আক্রমণ করতে এসে ‘সিন্ধু’ শব্দকে পালটে দেয়৷ তখন থেকে পরিচয় পেয়েছে ‘হিন্দু’ শব্দটি৷ এরপর থেকে ভারতের আরেক নাম হয়েছে হিন্দুস্তান, অর্থাৎ হিন্দুদের আবাসস্থল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Hassan
বহুধর্মের অবস্থান
চারটি ধর্মের জন্মস্থান ভারত৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারী সনাতন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের৷ দেশটির ৮৪ শতাংশ মানুষ নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেন৷ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম যেসব দেশে বাস করেন, তার একটি ভারত৷ দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের মানুষও বসবাস করে আসছেন দেশটিতে৷ তবে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনে এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷
ছবি: Imago/Indiapicture
দেবীর সম্মান
ধর্মীয় দিক থেকে নারীকে দেবীর মর্যাদায় আসীন করেন হিন্দুরা৷ কিন্তু বাস্তবে দেশটিতে নারীরা এখন ব্যাপক হারে নির্যাতনের শিকার৷ নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি মনে করা হয় ভারতকে৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যৌতুক ও ভ্রুণহত্যাও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: Save The Children India
গরুর মর্যাদা
ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে গরু পবিত্র প্রাণী৷ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী গরু নিজে দেবতা না হলেও কৃষ্ণ বা শিবের মতো অনেক দেবতার বাহন হিসেবে গরুর সম্মানও অনেক৷ দেশটির অর্থনীতিতেও গরু বড় ধরনের ভূমিকা রাখে৷
ভারতকে অনেকেই নিরামিষভোজী জাতি বলে মনে করেন৷ সরকারি জরিপে দেখা গেছে ভারতীয়দের এক-তৃতীয়াংশই মাংস খান না৷ তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ‘চাপে’ অনেকে মাংস, বিশেষ করে গরুর মাংস’ খাওয়ার কথা প্রকাশ করতে চান না৷ ফলে প্রকৃত নিরামিষভোজীর সংখ্যা অনেক কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷
ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে ‘উপবাস’ হিন্দু ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ তবে উপবাস মানে এই নয় যে সবসময় কিছুই না খেয়ে থাকতে হবে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু খাবার খাওয়া যায়৷ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মহাত্মা গান্ধীও উপবাসের এক দৃঢ় সমর্থক ছিলেন৷
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অভিবাদন জানানোর মাধ্যম হিসেবে ‘নমস্তে’ এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ বাংলায় এই অভিবাদনকে ‘নমস্কার’ বলা হয়৷ বিদায় নেয়ার সময়ও একইভাবে হাতজোড় করে ‘নমস্তে’ বলাটা সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত৷
ছবি: Nishant Aneja/Pexels
ভারতের অআকখ
জ্যোতির্বিদ্যা, বলিউড এবং ক্রিকেট, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই তিনটিকেই ভারতের হৃৎস্পন্দন বলা চলে৷ দেশটির ইন্টারনেটেও সবচেয়ে বেশি সার্চ করা হয় এই তিন বিষয় সংক্রান্ত সংবাদ৷
ছবি: Getty Images/AFP/W. West
বিয়ে
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মতো বছরের যে-কোনো দিনে চাইলেই আপনি বিয়ে করতে পারবেন না৷ শুভ দিন বেছে নিতে বাবা-মায়েরা জ্যোতিষী এবং পুরোহিতদের পরামর্শ নেন৷ হিন্দু পরিবারগুলোতে পাত্র-পাত্রীর কুষ্ঠিও মেলানো হয়৷ ঐতিহ্যবাহী হিন্দু বিয়ে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে৷ মূল বিয়ের আগে-পরেও নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়৷
ছবি: Orhan Cicek/Anadolu Agency/picture-alliance
বিবাহিত নারীর প্রতীক
টিপ, চুড়ি ও সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীদের প্রতীক৷ অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন, নারীর বৈবাহিক পরিচয়ের বাইরে শরীরের ওপরও এসবের প্রভাব রয়েছে৷