১৯৫৩ সালের ২৯শে মে এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিটে নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমান্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের শৃঙ্গে পা রাখেন৷ অনুভূতিটা ছিল উত্তেজনার নয়, বরং সন্তুষ্টির, পরে বলেছেন হিলারি৷
বিজ্ঞাপন
মাথার উপর সুউচ্চ আকাশ৷ নয়তো পৃথিবীটা নীচে পড়ে৷ এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা তখন ছিল ৮,৮৫০ মিটার৷ হিলারি আর তেনজিং-এর আগেও বহু পর্বতারোহী এভারেস্টে ওঠার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি৷ তেনজিং মারা যান ১৯৮৬ সালে৷ হিলারি ২০০৮ সাল অবধি বেঁচে ছিলেন৷
এভারেস্ট জয়ের ষাট বছর
১৯৫৩ সালে এডমান্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন৷ মানব জাতির ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে৷ আর ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
প্রথম জয়, প্রথম মৃত্যু
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের সর্বোচ্চ শেখরে পা রাখেন মুসা ইব্রাহীম (বামে)৷ সেই জয়ের খবরে আনন্দের বন্যা নামে বাংলাদেশে৷ আর ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মারা যান সজল খালেদ৷ এই ছবিঘরে মানবজাতির এভারেস্ট জয়ের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে৷ একেবারে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে৷
ছবি: Musa Ibrahim
কোড ম্যাসেজ
‘‘স্নো কন্ডিশনস ব্যাড স্টপ অ্যাডভান্সড বেস এবানডন্ড মে টোয়েন্টিনাইন স্টপ অ্যাওয়েটিং ইমপ্রুভমেন্ট স্টপ অল ওয়েল’’ এই ম্যাসেজের অর্থ হচ্ছে: ‘‘হিলারি এবং তেনজিং ২৯ মে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেছে৷’’ ১৯৫৩ সালের পহেলা জুন এই তথ্য লন্ডনে পৌঁছায়৷ এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরে মানুষের পদচিহ্নের খবর শুনে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কে আগে চূড়ায় উঠেছিল?
নিউজিল্যান্ডের এডমান্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে (ছবিতে বামে) এভারেস্ট জয়ের পর এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এই দু’জনের মধ্যে কে আগে চূড়ায় পা রেখেছিলেন তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক৷ নেপাল এবং ভারত এই জয় তাদের দাবি করে৷ তবে এভারেস্ট জয়ের কয়েক বছর পর হিলারি জানান, চূড়ায় ওঠার সময় তিনি তেনজিং এর থেকে কয়েক পা সামনে ছিলেন৷
ছবি: DW/S. Nestler
অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয়
হিলারি ও তেনজিং-এর সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পরের তিন দশকে বহু পর্বতারোহী বিভিন্ন পথ ধরে এভারেস্টে উঠেছেন৷ ১৯৭৮ সালে সাউথ টাইরোলিয়ান রাইনহোল্ড মেসনার (ডানে) এবং অস্ট্রেলিয়ান পিটার হেবেলার (বামে) অক্সিজেনের বাড়তি জোগান ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দলে দলে এভারেস্ট জয়
১৯৯০ দশকের দিকে দল বেধে পর্বতারোহীরা এভারেস্ট জয় শুরু করেন৷ সেই সময় থেকে প্রতিবছর শত শত পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় উঠছেন৷ রেকর্ড বলছে, এখন অবধি কমপক্ষে ৬,০০০ বার সফলভাবে এভারেস্টের চূড়া জয় করেছে মানুষ৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এভাবেই এভারেস্টের চূড়ার দিকে যাত্রা করেন পর্বতারোহীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চূড়ায় পর্বতারোহীদের ভিড়
সফলভাবে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চূড়ান্ত পর্যায়ে অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প থেকে কমপক্ষে চারদিন সময় লাগে আর এই সময়টা আবহাওয়া অবশ্যই ভালো থাকতে হবে৷ সাধারণত একইসময়ে অনেক অভিযাত্রী চূড়ার দিকে যাত্রা করেন, কেননা সবাই আবহাওয়ার পূর্বাভাষের উপর নির্ভরশীল৷ ফলে একদিনে অনেক পর্বতারোহীকে চূড়ায় এভাবে ভিড় করতে দেখাটা স্বাভাবিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেরপারা পথ দেখান
শেরপাদের সহায়তা ছাড়া কারো পক্ষে এভারেস্টের চূড়া জয় করা কার্যত অসম্ভব৷ তাঁরা এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পথের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সদা তৎপর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৮০ বছরে এভারেস্ট জয়
এভারেস্ট প্রতি বছরই চলে রেকর্ড গড়ার এবং ভাঙার খেলা৷ এই বসন্তে আশি বছর বয়সি জাপানি বৃদ্ধ ইউচিরো মিউরা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রেখেছেন৷ এর আগে ২০১০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন জর্ডান রেমেরো৷ দুটোই রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার তৎপরতা
২০০৩ সালে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি৷ দশ বছর পর মানে এখন এভারেস্ট বেসক্যাম্প পর্যন্ত হেলিকপ্টারে যাতায়াত স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এখন অবধি সর্বোচ্চ ৭,৮০০ মিটার উচ্চতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
এভারেস্টে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভারেস্টেরও ক্ষতি হচ্ছে৷ গত পঞ্চাশ বছরে সেখানকার বরফের পরিমাণ কমেছে ১৩ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্বের এভারেস্ট
এভারেস্টের অধিকাংশ অংশই নেপালের আওতায় রয়েছে৷ ফলে এভারেস্টকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয় করে দেশটির সরকার৷ প্রতি বছরের ২৯ মে ‘আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবস’ উদযাপন করে নেপাল৷ ১৯৫৩ সালের এই দিনে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিল মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পর্যটক কমাতে অনাগ্রহী নেপাল
এভারেস্টের চূড়ায় আরোহনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিধিনিষেধ আরোপ করার পক্ষে নয় নেপাল৷ বরং প্রয়োজনীয় টাকা থাকলে যেকেউ চেষ্টা করতে পারে এভারেস্ট জয়ের৷
ছবি: DW/S. Nestler
বাংলাদেশের এভারেস্ট জয়
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷ এরপর আরো চারজন বাংলাদেশি এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন৷ এদের মধ্যে দু’জন মেয়ে৷ আর ২০১৩ সালে চূড়া জয় করে নামার পথে ‘ডেথ জোনে’ মারা যান সজল খালেদ৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
13 ছবি1 | 13
হিলারি ও তেনজিং-এর সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পরের তিন দশকে বহু পর্বতারোহী বিভিন্ন পথ ধরে এভারেস্টে উঠেছেন৷ তার পরের ২৫ বছরে এভারেস্ট যাত্রা যেন পর্যটকদের বাঁধা রুটে পর্যবসিত হয়েছে৷ আজকাল তো ক্যাটালগ থেকেই এভারেস্ট যাত্রা বুক করা যায়৷ শৃঙ্গের চূড়া অবধি খুঁটি আর দড়ি বাঁধা আছে৷
শেরপাদের সাহায্য নিয়ে এ বছরের বসন্তে পাঁচশোর বেশি মানুষ এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন৷ তাদের মধ্যে ছিলেন এক ৮০ বছরের জাপানি বৃদ্ধ৷ আজকাল প্রায় সব এভারেস্ট আরোহী অক্সিজেনের মুখোশ পরে থাকেন, কেউ কেউ তো ৫,৩০০ মিটার উচ্চতায় আরোহণ শুরু হওয়ার সময় থেকেই৷
এমনকি নিজেদের অক্সিজেনের সিলিন্ডারগুলো নিজেরা বহন করতেও কষ্ট হয় এদের৷ তাই কিছু কিছু হবু ‘এভারেস্ট বিজয়ী' অক্সিজেনের সিলিন্ডারগুলি সামনের শেরপার কাঁধে রুকস্যাকে ঝুলিয়ে নিজেরা টিউব দিয়ে অক্সিজেন শুঁকতে শুঁকতে চলেন৷ রাইনহোল্ড মেসনার কিংবা রাল্ফ ডুইমোভিটস-এর মতো ধ্রুপদী পর্বতারোহীদের কাছে এটা ‘ডোপিং' ছাড়া আর কিছু নয়৷
যে ক'টা দিন এভারেস্টে চড়া যায়, সে ক'দিন পিঁপড়ের মতো সারি দিয়ে পর্বতারোহীদের বাঁধা পথ ধরে উপরে উঠতে দেখা যায়৷ এভারেস্টে ওঠার মানে এককালে ছিল, বিশ্বের গম্ভীরতম গিরিশৃঙ্গগুলির উদাসীন নির্জনতায় সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া৷ আজ অনেক নামী-দামী পর্বতারোহীরা তাদের নির্ঘণ্ট থেকে এভারেস্টকে বাদ দেওয়ার কথাই ভাবছেন, অন্তত সেখানে প্রত্যাবর্তন করার তাদের কোনো ইচ্ছা নেই৷
এভারেস্টের উচ্চতা একই আছে৷ পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ শুধু তার আভিজাত্য, তার একাকীত্ব, তার রোমাঞ্চ হারিয়েছে৷