হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার ইরানের প্রেসিডেন্টের হুমকির পর ট্রাম্প পাল্টা হুমকিতে বলেছেন, এমন কথা আরেকবার বললে খবর আছে! তার জবাবে ইরানের এক জেনারেল বলেছেন, ট্রাম্পের এসব ফাঁকা আওয়াজে কাজ হবে না৷
বিজ্ঞাপন
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কার্যকারিতা কতটুকু থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ ২০১৫ সালের চুক্তিটিতে বাকি পাঁচ দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন থাকতে চাইলেও নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷
তারওপর তাদের এই সরে যাওয়ায় ইরানের অর্থনীতি আবারো সংকটের মুখে পড়েছে৷ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক ইরানে বিনিয়েোগ করা থেকে সরে গেছে৷ কারণ, ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের৷ এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চরম বিরক্ত ইরান সরকার৷
প্রেসিডেন্ট রুহানির কণ্ঠেও তাই প্রচণ্ড বিরক্তি৷ রোববার তাই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি৷
‘‘আমরা এই প্রণালীর নিরাপত্তা সর্বদাই নিশ্চিত করেছি৷ সিংহের লেজ নিয়ে খেলবেন না৷ তাহলে আজীবন পস্তাতে হবে৷'' বলেন তিনি৷
যুগ যুগ ধরে হরমুজ প্রণালী আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল পরিবহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট৷ পারস্য উপসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে সংযোগ ঘটিয়ে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপন করে এটি৷
রুহানির অভিযোগ, যখনই ইউরোপের সঙ্গে কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা জাগে, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ঝামেলা পাকায়৷ তাই তাঁর প্রচ্ছন্ন হুমকি, ‘‘অ্যামেরিকার জানা উচিত যে, সব শান্তির ওপরে ইরানের সঙ্গে শান্তি৷ আবার সব যুদ্ধের ওপরে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ৷''
এদিকে, এই হুমকি শুনেই ক্ষেপে গিয়েছেন ট্রাম্প৷ বরাবরের মতোই এক টুইট বার্তায় উত্তর দিয়েছেন তিনি৷ লিখেছেন, ‘‘আর কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেয়ার ভুল করবেন না৷ ইতিহাসে অনেকেরই পরিণতি ভালো হয়নি৷ আপনারও হবে না৷''
তাঁর এই টুইটের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ এই টুইটকে রুহানির বক্তব্যের ‘পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া' বলে অভিহিত করেছে৷
এমনকি ইরানের বাসিজ মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধান বলেছেন যে, ট্রাম্পের এই বক্তব্য একটি ‘মনস্তাত্বিক যুদ্ধ'৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর প্রতিক্রিয়াটি ছিল এমন, ‘‘ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বিবৃতি একটি মনস্তাত্বিক যুদ্ধ৷ ইরানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবার অবস্থায় নেই তিনি৷''
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷