গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারকে ফের হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে৷ ঘটনাটি নিজের ফেসবুক পেজে লিখে জানান তিনি৷ এর আগেও একাধিকবার হত্যার হুমকি পান ডা. সরকার৷ উগ্রপন্থিদের ‘হিট লিস্ট'-এও রয়েছে তাঁর নাম৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে ডা. সরকার বলেন, ‘‘হুমকি-ধামকি দিয়ে আমাকে থামানো যাবে, এটা ভাবাও অবান্তর৷ যে দেশে খুন-ধর্ষণেরই বিচার হয় না, সেদেশে হুমকি তেমন বড় কোনো ঘটনা নয়৷ তাই এবার আমি থানায় কোনো জিডি করিনি৷ পুলিশকেও জানাইনি কিছু৷ আমায় যখন প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হয়েছিল, তখন আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি৷ তাই এবার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে না জানানোটা আমার এক ধরনের প্রতিবাদ৷ তবে দেশের এই পরিস্থিতিতে আমি মোটেও নিরাপদ বোধ করছি না৷ এর কারণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোশকতা দেয়া হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই বৈধতা দেয়া হচ্ছে৷ এই বৈধতার আড়ালে হত্যাকারীরা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছে যে, কাউকে হত্যা করতে কুণ্ঠা বোধ করছে না৷''
ইমরান এইচ সরকার
নিজের ফেসবুক পেজে ইমরান এইচ সরকার লেখেন, আজ (রবিবার) সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে ‘ইউনাইটেড কিংডম'-এর কোড সংবলিত একটি নম্বর থেকে আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, আমাকে শিগগিরেই হত্যা করা হবে৷ আমি জানতে চাইলাম, কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন? কিন্তু কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি৷ বারবার শুধু বলা হয়েছে, হত্যা করা হবে৷ কোথায়, কিভাবে খুন করবেন? – এ কথা জানতে চাইলে কল কেটে দেয়া হয়েছে৷ ডা. সরকার লিখেছেন, ‘আমি জানি, এটা জানানো কিংবা না জানানোতে তেমন কিছু আসে যায় না৷ তারপরও মনে হলো, সবাইকে জানিয়ে রাখা দরকার৷'
ডা. ইমরান এইচ সরকার আরও লেখেন, ‘কয়েকদিন আগে কিছু পথভ্রষ্ট রাজনীতিক তো আমাকে প্রকাশ্যেই হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন৷ তার কি বিচার হয়েছে? প্রকাশ্যে হত্যার হুমকির পর আমার এক পুরনো বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন, হত্যার ষড়যন্ত্রের বিচার হলে প্রকাশ্যে হুমকির বিচার হবে কিনা? আমি উত্তর দিয়েছি, আমি কৃষকের সন্তান, প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হলে নিশ্চয়ই হতো৷'
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচারের দাবি করায় এ ধরনের হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করেন কিনা – এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই৷ খুন-ধর্ষণ-লুটপাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পর থেকেই হুমকির মাত্রা বেড়ে গেছে৷ ক্ষমতাসীন অনেকে তো প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছেন এখন৷''
এর আগে গত বছরের ১৬ অক্টোবর হুমকি পাওয়ার ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, হুমকির মিছিলের সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে বাংলাদেশে৷ তাই পুলিশের সহায়তা নিচ্ছেন তিনি৷ ডা. সরকার বলেছিলেন, যে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁকে হুমকি দেয়া হয়েছে সেটির সঙ্গে ‘ইসলামিক স্টেট'-এর সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির বিভিন্ন পাতা এবং গ্রুপে সদস্যপদ রয়েছে অ্যাকাউন্টটির৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
ইমরান মনে করেন, ‘‘উগ্রপন্থিদের দমনে সরকারের কঠোর উদ্যোগ নেয়ার সময় এসেছে৷ অন্যথায় বাংলাদেশে উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে৷''
ডা. ইমরান এইচ সরকারকে এমন সময় হুমকি দেয়া হলো, যখন ঠিক তার দু'দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়েছে৷ এর আগে গত ৬ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মুক্তমনা লেখক নাজিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়৷ এই দু'টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিল রয়েছে৷ কারণ এঁরা দু'জনেই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন, কথা বলতেন৷ এখনও পর্যন্ত অবশ্য এই দুই হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই কুলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ৷ অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডে শুধুমাত্র সন্দেহভাজন একজন শিবির নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এছাড়া আর কোনো অগ্রগতি নেই৷
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০ জন মুক্তমনা লেখককে হত্যা করেছে উগ্রবাদীরা৷ কিন্তু তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আসল অপরাধী বা তাদের মদতদাতাদের কাউকেই ধরতে পারেনি পুলিশ৷
মুক্তমনদের হত্যা করা হচ্ছে৷ অথচ সরকার চুপ...এটা কি আপনি সমর্থন করেন? জানান নীচের ঘরে৷