1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হৃদয় মন্ডলের ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন কিছু?

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
১৫ এপ্রিল ২০২২

প্রশ্ন আসলে একাধিক৷ ধর্ম বনাম বিজ্ঞান- এমন বিতর্ক কি খুবই প্রয়োজনীয়? যদি কেউ এ নিয়ে গবেষণা করতে চায়, তো করুক৷ কিন্তু বিষয়টিকে স্কুলের ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়া কেন? 

ছবি: bdnews24

নিম্ন অথবা মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন বিতর্কের জন্ম নেয়-ই বা কেন? তাদের চিন্তার মধ্যে বিষয়টি কি মতলবী কোনো গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছে? নাকি তাদের পাঠ্যক্রমের মধ্যেই রয়ে গেছে বিতর্কের বীজটি?

এতসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার আগে না হয় বহুল আলোচিত হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিষয়টা একটু বলে নিই৷ ঘটনাস্থল রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী মুন্সীগঞ্জ জেলার পঞ্চসারে৷ সেখানকার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ বিদ্যালয়টি বেশ পুরানো, ১৯১৯ সালে এর প্রতিষ্ঠা৷ এ স্কুলেই গত ২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল৷ তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক৷ তার নিজের ভাষায়- তিনি ছিলেন ‘গোল আলু’র মতো৷ গণিত, বিজ্ঞান- সবই পড়াতেন৷ ছাত্রদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা একেবারে কম নয়৷ সেই হৃদয় মন্ডল জেলে গেলেন ২২ মার্চ, আজ থেকে তিন সপ্তাহ আগে৷ কারণটা আর কিছু নয়, তিনি তার শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের সঙ্গে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন৷ বিজ্ঞান আগে নাকি ধর্ম আগে, বিজ্ঞান কি ধর্মকে অনুসরণ করছে- ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক৷ ছাত্রদের মধ্যে কেউ সেই বিতর্কটা রেকর্ড করেছে, তারপর সেটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে৷ এ নিয়েই বিশাল হইচই৷ হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মাইকিং হয়েছে৷ উত্তেজিত মানুষ জড়ো হয়েছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে৷ হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে- ‘ধর্ম অবমাননার৷’ মামলা হয়েছে একটা৷ 

মামলার বাদী স্কুলেরই অফিস সহকারী মো. আসাদ৷ পরে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন তিনি মামলা করেছিলেন৷ আসাদ জানান, প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি বাদী হয়েছেন৷ তিনি কি শুনেছিলেন- কী বলেছেন হৃদয় মণ্ডল? কিভাবে কোন কথার মাধ্যমে তিনি ধর্মকে অবমাননা করলেন? একটা টেলিভিশন রিপোর্টে দেখলাম, সরল ভঙ্গিতেই মো. আসাদ জানালেন- তিনি আসলে কিছুই জানেন না৷ শ্রেণিকক্ষের সেই বিতর্কের সময় তিনি সেখানে ছিলেন না৷ এমনকি, কথাবার্তার যে রেকর্ড, সেটাও তিনি শোনেননি৷ বিবাদী কী বলেছেন, বাদী সেটা শুনেননি৷ কিভাবে ধর্মের অবমাননা হয়েছে, সেটাও তিনি জানেন না৷ তারপরও মামলা হয়ে গেছে৷ কেবল তা-ই নয়, বিচারক হৃদয় মণ্ডলকে জামিনও দেয়নি, জেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন৷

হৃদয় মণ্ডল জেলে থাকলেন প্রায় তিন সপ্তাহ৷ এই সময়ে বিষয়টি নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা হলো৷ পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে দাঁড়িয়ে গেল৷ শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকে হৃদয় মণ্ডলের পক্ষে যুক্তি দিলেন৷ তার কারাবাসের প্রতিবাদ করলেন৷ নানা ধরনের কথাবার্তা উঠে এলো৷ কেউ বললেন- পুরো রেকর্ডিংটা হয়েছে খুবই পরিকল্পিতভাবে৷ এই পরিকল্পনার পিছনে যারা, তারা আসলে হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসাতেই এই কাজটি করেছে৷ ছাত্রদেরকে ব্যবহার করেছে৷ বহিরাগতরাই যে একাজটি করিয়েছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, ছাত্ররা যখন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে তখন সেখানে বাইরের অনেক লোকই ছিল৷ তাদেরকেই বেশি সক্রিয় দেখা গেছে৷ প্রতিবাদের মুখে হৃদয় মণ্ডল প্রকাশ্যে ছাত্রদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন৷ কিন্তু তারপরও ওই বহিরাগতদের কারণে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি৷ এই বাইরের লোকগুলো কারা? ঘটনার পর এর মধ্যে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়নি৷ 

হৃদয় মণ্ডলের ঘটনায় এই যে বাদ-প্রতিবাদ, নানা মন্তব্য-যুক্তি, এর মধ্যে বিস্ময়ের সঙ্গে একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে৷ সেটা হচ্ছে, দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এই ঘটনায় কোনো মন্তব্য করেনি, কোনো ভূমিকা রাখেনি৷ সরকারের দুজন মন্ত্রী অবশ্য সতর্ক মন্তব্য করেছেন৷  কিন্তু তাদের বক্তব্য যে তাদের দলেরই অভিমত- সেটা কেউ পরিষ্কার করেননি৷ এই দুই মন্ত্রীর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য বেশ ইন্টারেস্টিং৷ তিনি হৃদয় মণ্ডলকে জেলে পাঠানোর বিষয়ে একটা যুক্তি দিয়েছেন৷ বলেছেন- তার নিরাপত্তার স্বার্থেই নাকি তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে৷ 

এর পাশাপাশি পুলিশ যা করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়৷ একাধিক আইনজীবী বলেছেন, পুলিশ আসলে এভাবে এই মামলা নিতেই পারে না৷ হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দণ্ডবিধির ২৯৫ এবং ২৯৫ক- এই দুই ধারায়৷ ২৯৫ ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মের অবমাননার উদ্দেশ্যে কোনো উপাসনার স্থান বা পবিত্র বস্তু ধ্বংস, নষ্ট বা অপবিত্র করার বিষয়ে৷ এই ধারাটি হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রে কিভাবে প্রযোজ্য, তা মোটেই বোধগম্য নয়৷ তিনি কথা বলেছেন দশম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে৷ এখানে উপাসনার স্থান, পবিত্র বস্তু ধ্বংস নষ্ট বা অপবিত্র করার বিষয়টি এলো কিভাবে? ২৯৫ক ধারায় বলা হয়েছে- প্রতিহিংসাবশত কোনো শ্রেণির লোকের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননা করা৷ আলোচিত বিতর্কের রেকর্ডটি শুনলে দেখা যায়- কয়েকজন ছাত্র বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করে কিছু প্রশ্ন করে৷ শিক্ষক হিসাবে হৃদয় মণ্ডল তার জবাব দেন৷ এখানে ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননাই বা কিভাবে হলো? আবার এই দুটি ধারায় মামলা নেওয়া প্রসঙ্গে ফৌজদারী কার্যবিধিতেও কিছু বিধিনিষেধ আছে৷ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৬ ধারায় বলা হয়েছে ধর্ম অবমাননা বা ব্লাসফেমির ধারায় কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অবশ্যই সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে৷ কিন্তু হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার সময় পুলিশ সে ধরনের কোনো অনুমতি নেয়নি৷ 

কেবল পুলিশ কর্তৃক মামলা নেওয়াই নয়, দু’দুটি আদালতে কিভাবে হৃদয় মণ্ডলের জামিন নাকচ হয়ে গেল, সেটি নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একাধিক সিনিয়র আইনজীবী৷ আসলে সবকিছুর মধ্যেই যেন ছিল কিছুটা তাড়াহুড়ো, কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি অনুগত থাকার মানসিকতা৷ একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে প্রশাসন ও বিচারবিভাগের মধ্যে এ ধরনের আচরণ আসলেই অনাকঙ্ক্ষিত৷ 
এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ জেলে থাকার পর হৃদয় মণ্ডল জামিনে মুক্তি পেলেন৷ সরকারের সদিচ্ছায় হোক বা জনমতের চাপে পড়ে হোক, ছেড়ে দিতে হলো তাকে৷ ছেড়ে দেওয়ার সময় কিন্তু আর ‘নিরাপত্তা’র কথাটি বলা হলো না৷ আচ্ছা, মুক্তি তো পেলেন, পেয়ে তার নিজের বাড়িতেও গেলেন, কিন্তু তার জীবনটা কি আর আগের মতো থাকলো? তার মুক্তির খবরটি যেদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, সেদিনই এক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি দেখলাম৷ হৃদয় মণ্ডলের ছোট্ট শিশু কন্যাটি একটি জানালায় উঁকি দিয়ে ভিতরের দিকে তাকিয়ে আছে- এমন একটা দৃশ্য৷ ছবির ক্যাপশনে লেখা- ভিতরে তার বাবার জামিনের শুনানি চলছে, আর সেটাই উঁকি দিয়ে দেখছে ছোট্ট মেয়েটি৷ কী মর্মান্তিক দৃশ্য! নীচে আরো একটা ছবি ছিল, মুক্তির পর বাবার কোলে বসে ছিল ছোট্ট মেয়েটি৷ আচ্ছা,, এই মেয়েটির জীবনই কি আর আগের মতো থাকবে? পত্রিকাতেই পড়েছি- এই জেলে থাকার সময়টাতে হৃদয় মণ্ডলের ছেলে-মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারতো না৷ এমনকি স্কুলেও না৷ তাদের দেখলেই লোকজন নানা মন্তব্য করতো৷ এখন সেই মন্তব্য কি থেমে যাবে?

আচ্ছা, হৃদয় মণ্ডলকে নিয়ে যা কিছু ঘটলো, এসব কি এই দেশে খুব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ঠিক এই জায়গাতেই এসে যাবে একেবারে শুরুর প্রশ্নগুলো৷ ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷ বিশেষ করে অর্ধশিক্ষিতদের মধ্যে এটি একটি প্রিয় সাবজেক্ট৷ তারা ছোটখাটো বিতর্ক দিয়ে শুরু করে দ্রুতই বিষয়টিকে মারামারি পর্যায়ে নিয়ে যায়৷ এ কারণেই, এই বিরোধটিকে থামাতে কিছু কিছু দেশে ‘ব্লাসফেমি’ টাইপ আইনও করা হয়েছে৷ অর্থাৎ, এর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিকে এক ধরনের প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে৷ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এতে বরং ফল হয়েছে উল্টো৷ আইন অনুযায়ী আপনি যে কোনো ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন, আপনার ধর্মীয় অনুভূতিকে কেউ অবমাননা করলে, তাকে এই আইনের আওতায় এনে সাজা দেওয়া যাবে৷ বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় এই বিষয়েই বলা রয়েছে৷ এসব ধারার প্রয়োগ আমরা মাঝেমধ্যে দেখি৷ তবে বেশির ক্ষেত্রেই হয় ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগে৷ আর এমন অভিযোগ এলে পুলিশও তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়৷ গ্রেপ্তার করে ফেলে৷ আদালতের মনোভাবেও ভিন্ন কিছু দেখা যায় না৷ হিন্দু বা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও যে কিছু ঘটনা হয় না, তেমন নয়৷ তবে সেগুলো হয় সাধারণত মন্দির বা পূজামন্ডপ ভাংচুর বা অবমাননার ঘটনা ঘটলে, অর্থাৎ ২৯৫ ধারায়৷ ধর্মীয় অনুভূতির পক্ষে রাষ্ট্রের এমন প্রটেকশনের বিপরীত মত যে নেই, তা নয়৷ কেউ কেউ বলতেই পারেন, তাহলে বিজ্ঞান চেতনার অনুভূতির প্রটেকশন কোথায়? অথবা কেউ যদি নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী হন, সেটাকেই তার ধর্মীয় অনুভূতি হিসাবে বিবেচনা করেন, তাহলে তার প্রটেকশনই বা কোথায়? একই ধরনের আফসোস করতে পারেন আহমদিয়া সম্প্রদায় বা বাহাই ধর্মের অনুসারীরাও৷ যে রাষ্ট্রের মৌল নীতিতে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি থাকে, সেখানে আবার এরকম ‘ব্লাসফেমি’ টাইপ আইনও কিভাবে সহবস্থান করতে পারে- এমন প্রশ্নও কিন্তু একেবারে অসঙ্গত নয়৷
এই যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই কি এই বিরোধটা শিশু-কিশোরদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? একটা শিশু যখন তার সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে মানব সভ্যতার বিবর্তনের ধারা পড়ছে, কিংবা  বিজ্ঞান বইয়ে পৃথিবী সৃষ্টি কিংবা মানব বিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারছে, সেটা কি তারই ধর্ম বইয়ের শিক্ষার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হচ্ছে না? সে হিসাবে ধরতে গেলে তো বিজ্ঞান বইটিই অনেকের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ এখন এই বিজ্ঞান বইয়ের প্রণেতাদেরকে কি দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় অভিযুক্ত করা যাবে? এ আশঙ্কা কিন্তু সবসময়ই থেকে যায়৷

গ্রন্থ প্রণেতাদের কথা না হয় বাদ রাখি, কিন্তু বিজ্ঞান ও ধর্ম বই একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে যে শিশুকে, তার মানসিক দ্বন্দ্ব নিরসন করার কী ব্যবস্থা রয়েছে রাষ্ট্রের কাছে? পাশাপাশি দুই বইয়ে দুই ধরনের কথা পড়ার পর শিশুমনে দ্বিধা বা প্রশ্নের জন্ম হতেই পারে৷ সে প্রশ্নের জবাব সে পাবে কার কাছে? ক্লাসে শিক্ষকের কাছে? হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার পর কোনো শিক্ষক কি আর এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সাহস করবে? তাহলে কি এ ধরনের প্রশ্নকে নিরুৎসাহিত করা হবে? অথবা এমন প্রশ্নকে ‘বেয়াড়া’ বিবেচনা করে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হবে? কিন্তু শিশু যদি প্রশ্নই করতে না শেখে, তাহলে সে শিখবে কিভাবে? নতুন নতুন জ্ঞানের সন্ধান সে পাবেই বা কিভাবে? এসব প্রশ্নের জবাব কি আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা জানেন?

তাহলে আমাদের করণীয় কী? আমার এক বন্ধু, যিনি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করেন, তিনি মনে করেন, স্কুল পর্যায়ের কারিক্যুলাম এমন হওয়া উচিত যেখানে কোনো একটি বিষয়ের সঙ্গে অপর কোনো বিষয়ের কোনো প্রকার মৌলিক বিরোধ না থাকে৷ একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মতকে একই সঙ্গে ধারণ করা সম্ভব নয়৷ মেধা ও মানসিক বিকাশের জন্য সেটা স্বাস্থ্যকর নয়৷ তাহলে কি আমরা স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞান অথবা ধর্মশিক্ষা যে কোনো একটিকে তুলে দেবো? বন্ধুটি বললেন, ‘‘তুলে দিতে পারলে ভালো হতো৷’’ কথাটি তিনি খুবই মৃদুস্বরে বললেন৷ আবার বলার সময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন-কেউ খেয়াল করলো কিনা৷ এই যে ভীতির সংস্কৃতি, নিজের বিশ্বাসের কথাটি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে না পারা, এটিই আমাদের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা৷

মাসুদ কামাল, সাংবাদিকছবি: Hashibur Reza Kallol

আরো আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র এই সমস্যার বৃক্ষটিকে নানাভাবে পরিচর্যা করে চলেছে৷ সে জন্যই দেখা যায়, প্রতিবার বইমেলা শুরুর আগে পুলিশের কাছ থেকে নির্দেশনা আসে, মেলায় কোনো নতুন বই আনতে হলে সেটার বিষয়বস্তু পুলিশকে দেখিয়ে নিতে হবে! রাষ্ট্র কি কোনো একটি গোষ্ঠীকে ভয় পায়? তাদেরকে তেল দিয়ে চলে? 

এতদূর আলোচনার পর এ কথা উপলব্ধি করতে আর কোনোই সমস্যা হয় না যে, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, একমুখী শিক্ষা আর খুব সহজে সম্ভব নয় এই দেশে৷ এভাবেই চলবে৷ শিক্ষার্থীদের যত সমস্যাই হোক, স্কুল পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী পাঠ্যক্রম অব্যাহত থাকবে৷ দ্বিধান্বিত শিশুটি অবধারিত প্রশ্ন নিয়ে জনে জনে ঘুরে বেড়াবে৷ অর্ধশিক্ষিতদের কাছে গেলে সে নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী বিজ্ঞানকে অথবা ধর্মকে- বাতিল করে দেবে৷ বিজ্ঞানকে বাতিল করে দিলে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না, কারণ, বিজ্ঞান অনুভূতিকে অবমাননার জন্য কোনো আইন নেই৷ তবে ধর্মের বিষয়ে কিছু বলতে গেলে পড়বে দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ এর মধ্যেকার কোনো একটি ধারায়৷ 

তাহলে হৃদয় মণ্ডলের কি কোনো ভুল ছিল না? নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে কেউ কি একবার ভেবেছেন? এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কী করতেন আপনি? আমি তো মনে করি হৃদয় মণ্ডলও ভুল করেছেন৷ আচ্ছা ধরা যাক, আপনি গণিতের শিক্ষক হিসাবে খুবই উচ্চমানের৷ আপনি কি তৃতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে ক্যালকুলাস শিখাতে পারবেন? আপনি যত ভালো শিক্ষকই হন না কেন, পারবেন না৷ এই যে না পারা, এটা কিন্তু শিক্ষক হিসাবে আপনার অযোগ্যতা প্রমাণ করে না৷ আসলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলে বা মেয়েটির মস্তিস্ক ক্যালকুলাস ধারণ করার যোগ্যতাই এখনো অর্জন করেনি৷ ঠিক তেমনি, নবম বা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর পক্ষে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা সময়োপযোগী কোনো কাজ নয়৷ শিক্ষক যত ভালোই হোক, তিনি যত ভালো করেই বোঝান না কেন, ওই পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী বিষয়টিকে ধারণই করতে পারবে না৷ হৃদয় মণ্ডল সেই অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করেছিলেন৷ তিনি যদি কেবল বলতেন, ‘‘এটা এখানে আলোচনার বিষয় নয়৷ তোমাদের কৌতূহল থাকলে তোমরা দুটো বিষয় নিয়েই আরো পড়ালেখা করো, পরে নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে৷’’ তাহলেই হয়ে যেতো৷ কিন্তু তিনি তা করেননি, কৌশলী হননি৷ ফলে সহজেই মতলবী লোকদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়েছেন৷ আর আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র তো প্রায় সময়ই মতলবী লোকদের পক্ষে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ