দুষ্মন্ত দাভে, সলমন খুরশিদ, প্রশান্ত ভূষণ, বৃন্দা গ্রোভার, জয়ন্ত ত্রিপাঠি সহ সুপ্রিম কোর্টের ৭৬ জন সিনিয়ার আইনজীবী চিঠি দিলেন প্রধান বিচারপতি রামান্নাকে। তাদের দাবি, গত ১৭ ও ১৯ ডিসেম্বর দিল্লি ও হরিদ্বারে দুইটি আলাদা অনুষ্ঠান হয়। দিল্লির অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিল হিন্দু যুবা বাহিনী এবং হরিদ্বারের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন নরসিংহানন্দ। দুইটি জায়গাতেই হেট স্পিচ দেয়া হয়। এথনিক ক্লিনসিংয়ের যুক্তি দেখিয়ে মুসলিমদের গণহত্যার কথা বলা হয়।
চিঠিতে নরসিংহানন্দসহ মোট নয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এই ধরণের হেট স্পিচ দিয়েছেন।
আইনজীবীরা চিঠিতে অভিযোগ করেছেন যে, এটা নিছক হেট স্পিচ নয়, এটা একটা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হত্যার খোলাখুলি হুমকি দেয়া। যা ভারতীয় দণ্ডবিধির একাদিক ধারার বিরোধী।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে আইনজীবীদের আবেদন, অবিলম্বে তিনি যেন নিজে থেকে মামলাটি হাতে নেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। আইনজীবীদের আশা, প্রধান বিচারপতি দ্রুত ব্যাবস্থা নেবেন।
পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক নেতারা হেট স্পিচে মেতেছেন৷ তবে রাজনৈতিক ইতিহাসে হেট স্পিচ নতুন কিছু নয়৷ নানা সময়ে নানা নামে নানা কায়দায় হেট স্পিচ চালু ছিল৷ ছবিঘরে তারই কিছু উদাহরণ দেওয়া গেল৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltdবিশ্ব রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের জন্য নাম কিনেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ একবার নয়, বার বার হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ তাঁর টার্গেট হয়েছেন কখনো মুসলিমরা আবার কখনো আফ্রিকার মানুষেরা৷ একদা তিনি বলেছিলেন, মুসলিমদের দেশে ঢোকা বন্ধ করে দেবেন তিনি৷ আর আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানুষদের বিষয়ে বলেছিলেন, তাঁরা ‘শিটহোল’ দেশ থেকে এসেছেন৷ যা নিয়ে প্রভূত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Harnikগোটা ইউরোপেই এখন অতি দক্ষিণপন্থিদের বারবাড়ন্ত৷ হল্যান্ডে এখনো দক্ষিণপন্থিরা সেভাবে থাবা বসাতে না পারলেও ডাচ নেতা খেয়ার্ট ভিল্ডার্স সংসদে দাঁড়িয়ে যে বক্তৃতা করেছিলেন তা ডাচ ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের দিন৷ ভিল্ডার্স বলেছিলেন, ইসলাম একটি খারাপ বিষয়৷ ইসলামের জন্য হল্যান্ডের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে৷ সংসদেই ভিল্ডার্সকে এরপর চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অন্যান্য সংসদেরা৷
ছবি: Imago/Hollandse Hoogteভারতে বর্তমান শাসকদল বিজেপি এবং তার সহযোগীরা হেট স্পিচের জন্য বিখ্যাত৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি অভিযুক্ত গুজরাট দাঙ্গার জন্য৷ হেট স্পিচও দিয়েছেন তিনি একসময়৷ তবে সমসময়ে তাঁর শিষ্য এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হেট স্পিচের জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত হয়েছেন৷ উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একাধিক হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি প্রকাশ্যে৷ দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন৷
ছবি: Imago/Zumapressবিশ্বহিন্দু পরিষদ বিজেপিরই অন্যতম শাখা সংগঠন৷ সেই সংগঠনের প্রধান প্রবীণ তোগাড়িয়া একটি জনসভায় মুসলিমদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন৷ এরপর তাঁর বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়েছে৷ সে সব মামলা এখনো চলছে৷
ছবি: UNIডোনাল্ড ট্রাম্পের আগেও বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেট স্পিচের জন্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন৷ ট্রাম্পের সমকক্ষ না হলেও জর্জ ডাব্লিউ বুশ তাঁর অন্যতম৷ বর্ণবিদ্বেষমূলক নীতি গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে৷ বিশেষত স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/S. Wenig১৯২৩ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন কোলড্রিজ৷ ১৯২৭ সালে হয় ভয়াবহ মিসিসিপি বন্যা৷ অভিযোগ, শ্বেতাঙ্গদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেও কোলড্রিজ কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থাই করেননি৷ বহু কৃষ্ণাঙ্গ সে সময় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন৷ পৃথিবী জুড়ে কোলড্রিজের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছিল৷
ছবি: Imago/Ralph Peters১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন৷ বহু ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হলেও অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো তিনিও হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ ক্ষমতায় এসে ফেডারেল শ্রমিকদের কাজের পুনর্নবিকরণ করেছিলেন৷ সে সময় অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গকে চাকরিচ্যূত করেছিলেন৷ যাঁদের কাজ বেঁচে গিয়েছিল, তাঁদের জন্য আলাদা খাওয়ার ঘর, কাজের পরিসরের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কাজ করার অধিকার ছিল না তাঁদের৷
ছবি: Getty Imagesকমিউনিস্ট, মুসলিম এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে তিনি যা বলেছেন, সবই হেট স্পিচ৷ শুধু বলেছেন না, ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছেন৷ বিশ শতকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের রেকর্ড আডল্ফ হিটলারের মুকুটেই৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltdতাঁর শাসনকালেই ‘ফাশিস্ত’ শব্দটির উদ্ভব৷ বিরোধীদের প্রসঙ্গে যে ধরনের মন্তব্য তিনি করতেন, তা এক কথায় হেট স্পিচ৷
ছবি: picture alliance/AP১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত উগান্ডার স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন ইদি আমিন৷ তাঁর আগের শাসক আবোটের অনুগামীদের বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করে তিনি নিজের সমর্থকদের তাতিয়ে দিতেন৷ অভিযোগ, আকোলি এবং ল্যাঙ্গো উপজাতির বিরুদ্ধেও একইরকম মন্তব্য করতেন তিনি৷ এবং শেষ পর্যন্ত ওই দুই উপজাতির মানুষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল তাঁর দলবল৷ উগান্ডার ইতিহাসে এখনো যা সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়৷
ছবি: Getty Imagesসোভিয়েত রাশিয়ার এই কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধেও হেট স্পিচের অভিযোগ আছে৷ কেবল অ্যামেরিকা নয়, তাঁর নিজের দেশের বিরোধীদের সম্পর্কেও বহু হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি৷ মানুষ উসকেছেন বিরোধীদের একঘরে করার জন্য৷ বস্তুত আয়রন ক্যাম্পও তাঁরই সৃষ্টি৷
ছবি: AFP/Getty Imagesতিনি ‘মিয়ানমারের বিন লাদেন’ হিসেবেও পরিচিত৷ এই কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট দিয়ে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন৷ তার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এতটাই প্রভাব বিস্তার করছিল যে ফেসবুক তাঁর পেজটি মুছে ফেলতে বাধ্য হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacadবাংলাদেশ ও এদেশের জনগণ পাকিস্তানের শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করায় এ নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর খুবই মনোকষ্ট ছিল৷ তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি যে, এদেশের মানুষ তাঁর কথার বিরোধিতা করেছে৷ এমনকি প্রকাশ্যে তিনি জনসভাতেই বলে ফেলেছিলেন৷ ঢাকায় এক জনসভায় তিনি বলেই ফেলেছিলেন যে, ‘‘মঞ্জুর হ্যায় তো ঠিক হ্যায়, নেহি মঞ্জুর হ্যায় তো শুয়োর কে বাচ্চে, জাহান্নাম মে যায়ে৷’’
ছবি: STF/AFP/GettyImages স্ক্রোল জানাচ্ছে, এই দুইটি অনুষ্ঠানের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। দিল্লির অনুষ্ঠানে একটি টিভি চ্যানেলের প্রধান সম্পাদক ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার জন্য বেশ কয়েকজনকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন। হইচই হওয়ার পর পুলিশ গত ২৩ ডিসেম্বর শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের সাবেক প্রধান জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে। কিছুদিন আগে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
ওয়েইসির বিতর্কিত ভাষণ
এআইএমআইএম নেতা ও সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়েইসি সম্প্রতি কানপুরে বলেছেন, ''আমি উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, যোগী চিরদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না, মোদী চিরদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। মুসলমানরা জুলুম ভুলবে না। সেটা মনে রাখবে। অবস্থার পরিবর্তন হবে। তখন কে বাঁচাবে আপনাদের।''
বিজেপি এই ভিডিও নিয়ে প্রবল হইচই শুরু করেছে। ওয়েইসির দাবি, হরিদ্বারের ঘটনা থেকে নজর সরাতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার ভাষণের কিছু লাইন তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি এই কথা পুলিশি অত্যাচার নিয়ে বলেছিলেন।
লোকমত পত্রিকার রাজনৈতিক সম্পাদক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলি একটা ন্যারেটিভ নিয়ে চলছে। তাতে উত্তরপ্রদেশে ভোটে বিজেপি-সুবিধা পেতেই পারে। তবে ভোটে সুবিধা হোক না হোক তারা কিছুদিন হলো এই ধরণের কথা বলে চলেছে।''
শরদের মতে, ''হেট স্পিচ যারা দিয়েছেন, সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ব্যবস্থা নেয়া উচিত ওয়েইসির বিরুদ্ধেও।''
জিএইচ/এসজি(এনডিটিভি, লাইভ ল, রিপাবলিক টিভি)