বাংলাদেশে বড় দুই রাজনৈতিক দলের কারণেই মৌলবাদের উত্থান ঘটছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ তাঁরা মনে করেন, দু’টি দলই ভোটের রাজনীতিতে অতীতে যেমন ধর্মকে ব্যবহার করেছে এখনো করছে৷
বিজ্ঞাপন
শাহবাগের কথিত ‘নাস্তিক' ব্লগাদের ফাঁসি, ব্লাসফেমী আইন প্রণয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে যত ভাস্কর্য আছে সব ভেঙ্গে ফেলা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবিতে লংমার্চের পর শনিবার ঢাকার মতিঝিলে অনুষ্ঠিত হয় হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ৷ মহাসমাবেশ থেকে এই দাবি আদায়ে ৮ এপ্রিল হরতাল এবং ৫ মে ঢাকা অবরোধের নতুন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে৷ সমাবেশ সরকারকেও ‘নাস্তিক' বলে অভিহিত করে পতন ঘটানোর কথা বলা হয়৷
‘জামায়াতকে রক্ষার আন্দোলন'
অন্যদিকে এই লংমার্চ প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ পঁচিশটি সংগঠনের ডাকে সারদেশে ২৪ ঘণ্টার হরতাল শেষ হয়েছে শনিবার সন্ধ্যায়৷ হরতালে কোন সহিংসতা না হলেও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানান সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ৷ বিকেলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ থেকে জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়৷ বলা হয়, হেফাজতের আন্দোলন জামায়াতকে রক্ষার আন্দোলন ছাড়া আর কিছুই নয়৷
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের মিছিল থেকে ঢাকার মহাখালীতে শাহরিয়ার কবিরসহ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সাংস্কৃতিক জোট নেতাদের ওপর হামলা চালান হয়েছে৷ ফরিদপুরে হেফাজত, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে একজন আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হয়েছেন৷
আক্রান্ত নারী সাংবাদিক
হেফাজতের লোকজন ঢাকায় সাংবাদিকদের ওপরও হামলা চালিয়েছে৷ তারা হামলা চালিয়েছে একুশে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর৷ পুরুষদের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এই অজুহাত তুলে তারা নাদিয়া শারমিনকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পোটায়৷ গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
সহায়তায় সরকার, বিরোধী দল
হেফাজতের এই লংমার্চে সরকার বাধা দিয়েছে বলে নেতারা অভিযোগ করলেও বাস্তবে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের সহাসমাবেশের অনুমতিসহ সব ধরনের সুবিধা দিয়েছে সরকার৷ এমনকি শাহরিয়ার কবিরের ওপর হামলার সময়ও পুলিশ হেফজতের পক্ষ নেয় বলে শাহরিয়ার কবির অভিযোগ করেছেন৷ এমনকি মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়ে মারার পরও হেফাজত কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ৷ আর সরকার আগেই তাদের দাবি মত কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়৷
অন্যদিকে হেফাজতের লোকজনকে পানি ও খাবার সরবরাহ করেছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি৷ আর মঞ্চে গিয়ে বিএনপির পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং জাতীয় পার্টির পক্ষে কাজী জাফর আহমেদ৷ এই দুটি দল ও জামায়াতে ইসলামী আগেই হেফাজতের কর্মসূচিকে সমর্থন দেয়৷ তাদের লোকজন বিপুল সংখ্যায় মহাসমাবেশে হাজির থাকে৷
‘নীতিহীন রাজনীতি'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দু'টি বড় রাজনৈতিক দলই সামনের নির্বাচনে ভোটের হিসাব করে হেফাজতে ইসলামকে পক্ষে নেয়ার নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কেউই এক্ষত্রে পিছিয়ে নেই৷ আর একারণেই বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটছে৷
‘‘দলগুলো যেকোনভাবে ক্ষমতায় যেতে চায় বা টিকে থাকতে চায়৷ তাই তাদের কাছে দেশের কল্যাণ বা অকল্যাণ বড় কথা নয়৷''
ড. আহমেদ বলেন, ‘‘এই নীতিহীন রাজনীতির কারণেই দেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে৷ এই মৌলবাদীরা আরো শক্তি সঞ্চয় করবে৷ তখন হয়তো সমালাবার পথ থাকবেনা৷''