হেফাজতে মৃত্যু কমছে না
২২ জানুয়ারি ২০২৩২০২১ সালের ডিসেম্বরের র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ২০২২ সালে এক বছরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তিনজন৷ কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৬ জন৷ ক্রসফয়ারে ২০২১ সালে ৫১ জন নিহত হয়েছেন, হেফাজতে মারা গেছেন ৩৯ জন৷
এর বাইরে কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনায় আসেনা বা আড়ালেই থেকে যায়৷ ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন৷ এদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ২৮ জন৷ বিচারাধীন ৩৭ জন৷ ২০২১ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৮১ জন৷ তাদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৯ জন৷ বিচারাধীন ৫২ জন৷ এইসব তথ্য মানবাধিকার সংঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক)৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান এ বিষয়ে বলেন, ‘‘কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা এখন অনেক বেশি৷ আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে তাদের একটি অংশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে গিয়ে মারা যান৷ আসলে এটা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ফল৷''
চলতি মাসের উদাহরণ
মুঠোফোনে বিটকয়েন দিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে গত ৭ জানুয়ারি রাতে চারজনকে আটক করে গাজীপুরের বাসন থানার পুলিশ৷ পরের দিন তিনজনকে ছেড়ে দিলেও ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামকে থানায় আটকে রাখা হয়৷ মঙ্গলবার রাতে বাসন থানার এসআই নুরুল ইসলাম ও মাহবুবসহ একদল পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে আসেন৷ পরে রাতে পরিবারের লোকজন জানতে পারেন, রবিউল মারা গেছেন৷ শুরুতে পুলিশ ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও বিক্ষুব্ধ লোকজন সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানালে পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ দু'জন সাব ইন্সপেক্টরকে প্রত্যাহার করা হয়েছ৷ নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ পুলিশের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে৷ তার পরিবার অভিযোগ করেছে ছেড়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিলো পুলিশ৷ পরিবারকে পুলিশ মামলাও করতে দেয়নি৷ পুলিশ বাদী হয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মামলা করেছে৷
নূর খান বলেন, ‘‘আমরা একটিও ক্রসফায়ার চাইনা৷ তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার কমেছে৷ কিন্তু থানা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমছে না৷ তারা মৃত্যুর ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে৷ যেগুলো পারেনা সেগুলো আমরা জানতে পারি৷ মৃত্যু ছাড়াও থানা হেফাজতে আরো অনেক নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি তাতে কেউ সাধারণত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে সাহস পায়না৷ আপস করতে বাধ্য হয়৷''
আর মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘আগে ক্রসফায়ার করত র্যাব৷ এখন পুলিশ হেফাজতে মারা যায়৷ এটা কৌশলের পরিবর্তন৷ সার্বিক পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন নয়৷ আমরা দেখছি ক্রসফায়ারের পরিবর্তে এখন হেফাজতে মারা যাচ্ছে৷''
তার কথা, ‘‘মানসিকতা ও আচরণগত পরিবর্তন এবং ঘটনার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় না আনা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবেনা৷''
হেফাজতে মৃত্যুর মাত্র একটি ঘটনায় শাস্তি
২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে একটিমাত্র ঘটনার বিচার হয়েছে৷ ১০ বছরে আর কোনো শাস্তির নজীর নেই৷ ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দুই ভাই ইশতিয়াক হোসেন জনি ও ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে আটক করে পুলিশ৷ পরে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় বড় ভাই জনির৷ ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় ওই আইনে মামলা করেন ইমতিয়াজ হোসেন রকি৷ ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলার রায়ে রায়ে মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ এক লাখ টাকা করে জরিমানা ও দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত৷ রায়ে বলা হয়, জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে আরও ছয় মাস করে কারাদন্ড ভোগ করতে হবে৷ এছাড়া দুই আসামিকে সাত বছরের কারাদন্ড দেন আদালত৷
এই সময়ে মামলাও তেমন হয়নি৷ সর্বোচ্চ ৩৫টির মতো মামলা হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, এই আইনটি জাতিসংঘ সনদ মেনে করা হয়৷ ফলে আইনটি একটি ইউনিক আইন৷ এই আইনে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনও অপরাধ৷ আর প্রচলিত স্বাক্ষ্য আইনের মত মামলা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর নয়, আসামিদের৷ ঘটনা যেখানেই ঘটুক বাংলাদেশের যে কোনো আদালতে মামলা করা যায়৷পুলিশের কাছেও মামলা করা যায়৷ সেটা নেবেন এসপি পদ মর্যাদার কর্মকর্তা৷ সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ আর হেফাজত বলতে সব ধরনের পুলিশ, কারাগার, এমনকি সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতকেও বোঝানো হয়েছে৷
তার কথা, ‘‘প্রথমত এই আইন সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নয়৷ এরপর কেউ মামলা করতে গেলে পুলিশ তাকে প্রভাব খাটিয়ে বিরত রাখে৷ আমি কয়েকটি মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি বাদীকে আপস করতে বাধ্য করা হয়৷ শুধু তাই নয় মামলা হলে প্রশিক্ষণের অভাবে তদন্তকারীরা ঠিকমত তদন্ত করতে পারেন না৷ আমি একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখেছি তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, বাদী ঘটনা প্রমাণ করতে পারেননি৷ কিন্তু এই আইনে সেটা বাদীর দায়িত্ব নয়, আসামির দায়িত্ব৷''
জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘এই আইনটি করা হয়েছে জাতিসংঘের চাপে৷ কিন্তু খেয়াল করবেন পুলিশ তাদের প্রত্যেকটা কনফারেন্সে এই আইনটি বাতিলের দাবি তোলে৷ তারা এই আইনটি চায়না৷ ফলে এই আইনের প্রচার নাই৷ আবার কেউ এই মামলা করতে গেলে তাকে বিরত রাখার সব কৌশল নেয়৷''
তার কথা, ‘‘জেলা ও দায়রা জজ আদালত পর্যন্ত এই আইনে মামলা করা যায়৷ ওই পর্যায়ে মামলা না নিলে মামলা করার আর সুযোগ থাকেনা৷ আবার তদন্ত দেয়া হয় পুলিশকে৷ তাহলে তদন্ত তো পুলিশের মতই হয়৷''