চট্টগ্রামে জমিয়াতুল উলুম আল মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতামূলক বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ তাদের দাবি, গ্রেনেড-বোমা তৈরির সময় এটা ঘটে৷ ঘটনার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী জড়িত বলে সন্দেহ৷
বিজ্ঞাপন
সোমবারের ঐ বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের মধ্যে একজন মাদ্রাসা ছাত্র মো. হাবিব হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার মারা গেছে৷ তার হাতের কব্জি উড়ে গিয়েছিল৷ পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এই ঘটনায় মুফতি ইজাহারুলসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে চট্টগ্রামের খুলসী থানায়৷ তাদের মধ্যে নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী এবং তার ছেলে পালাতক আছেন৷ তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷
পুলিশ কমিশনার জানান, সোমবার রাতে মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরণস্থল থেকে গ্রেনেড ও বোমা তৈরির বিস্ফোরক পাওয়া গেছে৷ পাওয়া গেছে বোমার স্প্লিন্টারও৷ এছাড়া মুফতি ইজাহারুলের বাসায় অভিযান চালিয়ে ১৮টি বোতল অ্যাসিড উদ্ধার করা হয়েছে৷ ইজাহারুলের বাসা মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে৷ তিনি জানান, বিস্ফোরণের পরপরই মাদ্রসার লোকজন পানি ঢেলে বিস্ফোরকের আলামত নষ্টের চেষ্টা করে৷ এছাড়া আগেই আগুনের কথা বলে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়ায়, তারা পানি দিয়ে আগুন নেভানোয় বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
তবে পুলিশ কমিশনার জানান, প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মাদ্রাসার ভেতরে গ্রেনেড এবং বোমা তৈরি করছিল৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের ওপরই হামলা করা৷ বিশেষ করে, সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় এগুলো তারা ব্যবহার করতো৷ আগামী ১২ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের সঙ্গে এই তত্পরতার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার বলেন, এখনও কোনো যোগসূত্র তারা পাননি৷ তবে তদন্ত চলছে৷
হেফাজতের ১৩ দফা, অস্থির বাংলাদেশ
ঢাকায় শনিবার (০৬.০৪.১৩) মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম৷ ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে এই সমাবেশ করে তারা৷ হেফাজতের এসব দাবির বিপক্ষে অবস্থান অনেকের৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ
আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর হিসাবে শনিবারে ঢাকার মতিঝিলে জড়ো হন লক্ষাধিক মানুষ৷ হেফাজতে ইসলাম এর সমর্থক তারা৷ সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী এই সমাবেশ থেকে তাদের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
কী আছে ১৩ দফায়?
শাহবাগের কথিত ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে যত ভাস্কর্য আছে সব ভেঙে ফেলা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের মতো দাবি রয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আক্রান্ত নারী সাংবাদিক
শনিবার মহাসমাবেশ চলাকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজন ঢাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়৷ তারা হামলা চালিয়েছে একুশে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর৷ পুরুষদের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এই অজুহাত তুলে তারা শারমিনকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটায়৷ সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য সাংবাদিকের ওপর হামলার দায় অস্বীকার করেছে হেফাজত৷
ছবি: Getty Images
সমর্থন, ধন্যবাদ
হেফাজতের এই মহাসম্মেলনে সরাসরি সহায়তা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জোট সঙ্গী জাতীয় পার্টি৷ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য হেফাজতে ইসলামকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর৷
ছবি: Reuters
‘নতুন কোন আইন নয়’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বিচারের জন্য নতুন কোনো আইন করার পরিকল্পনা সরকারের নেই৷ একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে হাসিনা বলেন, ‘‘সরকার হেফাজতের সবগুলো দাবিই দেখবে৷ এর মধ্যে কোনোটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে৷ আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, সেগুলো পূরণ করা হবে না৷’’
ছবি: dapd
‘দাবি মানার কোন কারণ নেই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হেফাজতের যে সব দাবি, তা মেনে নেয়ার কোন কারণ নেই৷ তারা দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়৷ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলাও ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে৷ এই হুমকিকে ভয় পায়না স্বাধীনতা এবং প্রগতির পক্ষের শক্তি৷’’
ছবি: AP
‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নারী স্বাধীনতা, প্রগতি, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনে নিলে দেশ অন্ধকার যুগে চলে যাবে৷ দেশে মোল্লাতন্ত্র চালু হবে৷ তা এদেশের মানুষ মানবেনা৷’’
ছবি: Reuters
নারী সমাজের প্রতিবাদ
নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং হেফাজতের নারী প্রগতি বিরোধী দাবির বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন নারী সমাজ৷ ঢাকায় একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশকে মধ্য যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চক্রান্ত সফল হবেনা৷ হেফাজত আর জামায়াত শিবির এক হয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়৷ কিন্তু তাদের এই ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবেনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে’
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেশের অগ্রগতি রুখতে চায়৷ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷’’
ছবি: REUTERS
ব্লগার গ্রেপ্তার
হেফাজতের শনিবারের মহাসমাবেশের আগেই অবশ্য ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য ও কটূক্তি’র অভিযোগে চার ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ অনেকে মনে করেন, সরকার দৃশ্যত হেফাজতের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করছে৷ আরো কয়েকজন ব্লগারকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
এদিকে চট্টগ্রামের সাংবাদিক রিয়াজ হায়দার ডয়চে ভেলেকে জানান, মুফতি ইজাহারুলের এই মাদ্রাসায় জঙ্গি তত্পরতার অভিযোগ ছিল অনেক আগে থেকেই৷ গত বিএনপি সরকারের সময় চট্টগ্রামের বাশখালী এলাকায় অস্ত্র এবং বিস্ফোরকসহ তাঁর বেশ কয়েকজন লোকজন ধরা পড়েছিল৷ তিনি জানান, মুফতি ইজাহার হেফাজতের নায়েবে আমির ছাড়াও নেজামে ইসলামের একাংশের চেয়ারম্যান৷ চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিহত করতে মাদ্রাসা ছাত্রদের তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷
চট্টগ্রামের লালখান বাজারের জমিয়াতুল উলুম আল মাদ্রাসাটি পাঁচ একর জায়গা জুড়ে৷ প্রাচীন এই কওমি মাদ্রাসাটিতে মোট ৮টি ভবন রয়েছে৷ তবে সোমবার রাতে পুলিশি অভিযানের পর মাদ্রাসাটি ফাঁকা হয়ে যায়৷ মুফতি ইজাহার ও তাঁর ছেলে হারুন পালিয়ে যাওয়ায়, ছাত্রদের একটা বড় অংশও পালিয়েছে৷ মাদ্রাসার চারপাশে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ৷ অবশ্য এ নিয়ে হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য জানতে তাদের একাধিক শীর্ষ নেতার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও, তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া য়ায়৷