হেলমুট কোল-এর দ্বিতীয় পত্নী, তাঁর প্রথম বিবাহের সন্তানেরা, বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, হাঙ্গেরির বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান– এরা সবাই এই নাটকের চরিত্র৷
বিজ্ঞাপন
আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে এককালে কোল-এর ‘মেইডশেন’ বা ‘খুকি’ বলা হতো, যার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে দুই প্রজন্মের দুই জার্মান রাজনীতিকের মধ্যে জটিল সম্পর্কের ইতিহাস৷ সেই ‘খুকি’ আজ কোল-এর মতোই খুব সম্ভবত চতুর্থবারের মতো জার্মান চ্যান্সেলর হতে চলেছেন, কোল-এর মতোই তিনি সিডিইউ দলের সভাপতি ও ইউরোপের প্রথম সারির নেতা – তবুও তাঁকে কোল-এর শোকানুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হচ্ছিল না বলে জানিয়েছে ‘ডের স্পিগেল’ পত্রিকা৷
হেলমুট কোল সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন ২০০২ সালে৷ পরবর্তীতে ম্যার্কেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক লক্ষণীয়ভাবে শীতল হয়ে পড়ে৷ সিডিইউ দলের বেআইনি চাঁদা ও বিদেশে বেনামা তহবিল সংক্রান্ত কেলেংকারি চলাকালীন ম্যার্কেল দৃশ্যত মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘‘কোল-এর স্বীকৃত এসব কার্যকলাপ (সিডিইউ) দলের ক্ষতি করেছে’’ – যা কোল-এর প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্ত সূচিত করে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস৷ এর স্বল্প পরেই ম্যার্কেল নিজে দলের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন ও পরে জার্মান ফেডারাল প্রজাতন্ত্রের প্রথম নারী চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন৷
জার্মানির ‘পুনর্মিলনের চ্যান্সেলর’ হেলমুট কোল (১৯৩০-২০১৭)
‘বিংশ শতাব্দীর বিসমার্ক’ হিসেবে গণ্য হতেন যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হেলমুট কোল৷প্রাক্তন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল পরলোক ৮৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন৷
ছবি: dapd
আর কেউ এতদিন চ্যান্সেলর থাকেননি
১৯৮২ সালের ১লা অক্টোবর হেলমুট কোল প্রথমবার চ্যান্সেলর হন৷ ১৬ বছর ধরে এই পদে অধিষ্টিত ছিলেন, অন্য যে কোনো চ্যান্সেলরের চেয়ে বেশি৷ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরম মুহূর্ত ছিল বার্লিন প্রাকারের পতন এবং জার্মানির পুনর্মিলনে৷ ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে তাঁর দল ব্যাপকভাবে হারার পর কোল সিডিইউ সভাপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন - যে পদ তিনি ২৫ বছর ধরে অলঙ্কৃত করেছেন৷
ছবি: dapd
আডেনাউয়ার-এর আমলে রাজনৈতিক উত্থান
১৯৪৭ সালে হেলমুট কোল সিডিইউ-তে যোগদান করেন৷ তিনি তাঁর জন্মের শহর লুডভিগসহাফেনে ‘যুব ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন৷ ১৯৫০ সালে আইন পড়তে শুরু করেন, পরে তার সঙ্গে যোগ হয় ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান৷ দলে খুব তাড়াতাড়ি পদোন্নতি ঘটে কোল-এর৷ ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি সিডিইউ দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য৷
ছবি: picture alliance / dpa
তরুণ মুখ্যমন্ত্রী
১৯৬৬ সালে হেলমুট কোল রাইনল্যান্ড-প্যালেটিনেট রাজ্যে সিডিইউ দলের সভাপতি হন, এবং তার তিন বছর পরে, ১৯৬৯ সালের মে মাসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পেটার আল্টমায়ার-এর স্থলাভিষিক্ত হন৷ দু’বছর পরে আরেক সাফল্য: হেলমুট কোল-এর নেতৃত্বে সিডিইউ দল ১৯৭১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়৷
ছবি: AP
সুখি পরিবার
বিশেষ করে ছুটি কাটানোর ফটোগুলিতে হেলমুট কোল একটি সুখি পরিবারের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাস্তবে তাঁর স্ত্রী হানেলোরে এবং দুই পুত্র ভাল্টার ও পেটার বাবা বাড়িতে না থেকে কাজে থাকায় কষ্ট পেয়েছেন৷ ভাল্টার কোল পরে সেই স্মৃতিচারণ করেন৷
ছবি: imago/Sven Simon
পঁচিশ বছর ধরে সিডিইউ প্রধান
১৯৭৩ সালের জুন মাসে হেলমুট কোল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দলের সভাপতি নির্বাচিত হন৷ ২৫ বছর ধরে তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন৷ প্রথমবারের সেই নির্বাচন ছিল বন শহরে, একটি বিশেষ দলীয় সম্মেলনে৷ কোল-এর অভিব্যক্তিতে বিজয়োল্লাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জীবন যেরকম
১৯৮২ সালে এসপিডি-এফডিপি সরকারি জোটে ভাঙণ ধরার পর মুক্ত গণতন্ত্রীরা ঝোঁকেন খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রীদের দিকে৷ তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিট-কে আস্থাভোটে পরাজিত করে উভয় দল হেলমুট কোল-কে নতুন সরকারপ্রধান নির্বাচিত করে৷ স্মিট স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কোল-কে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অন্য এক পুনর্মিলন
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোল পরমসখার মতো হাতে হাত ধরে? ছবিটি বিশ্বের সর্বত্র ছাপা হয়েছিল৷ সময়: ১৯৮৪ সাল৷ স্থান: ভ্যার্দঁ-তে জার্মান-ফরাসি মৈত্রী অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানে দুই নেতা পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন৷
ছবি: MARCEL MOCHET/AFP/Getty Images
জার্মান পুনর্মিলন
১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর কোল বিভক্ত জার্মানির পুনর্মিলনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান৷ ১৯৯০ সালের ৩রা অক্টোবর সাবেক পূর্ব জার্মানি ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্রে যোগদান করে – কোল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের তুঙ্গে পৌঁছন৷ বার্লিনে রাইশটাগ-এর সোপান থেকে হাত নাড়ছেন কোল ও তাঁর তৎকালীন স্ত্রী হানেলোরে৷
ছবি: picture alliance/dpa
ম্যার্কেলের গুরুপ্রতিম
হেলমুট কোল ছাড়া বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জার্মান রাজনীতিতে এতোবড় ভূমিকা নিতে পারতেন কিনা, বলা শক্ত৷ নব্বইয়ের দশকে কোল সাবেক পূর্ব জার্মানির রাজনীতিকটিকে প্রথমে ফেডারাল পরিবার মন্ত্রক, পরে পরিবেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব দেন৷
ছবি: picture alliance / dpa
১৬ বছর চ্যান্সেলর থাকার পর বিদায়
১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংসদীয় নির্বাচনে সিডিইউ দলের পরাজয় ঘটে, আসে চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার-এর লাল-সবুজ সরকার৷ প্রথা অনুযায়ী সামরিক প্যারেড সহ বিদায় দেওয়া হয় হেলমুট কোল-কে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্ত্রীবিয়োগ
২০০১ সালে আত্মহত্যা করেন হেলমুট কোল-এর ৪১ বছরের সহধর্মিনী হানেলোরে কোল৷ একটি দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে তিনি সূর্যালোক সহ্য করতে পারতেন না৷
ছবি: AP
নবজীবন
হানেলোরোর মৃত্যুর চার বছর পরে হেলমুট কোল তাঁর চেয়ে ৩৪ বছর কম বয়সের মাইকে রিশটার-কে বিবাহ করেন৷
ছবি: AP
12 ছবি1 | 12
২০১০ সালে কোল-এর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ম্যার্কেল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, কোল-এর অবদান ব্যতিরেকে ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা আমার মতো ১৯৯০ সাল অবধি পূর্ব জার্মানিতে বাস করেছেন, তাদের জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো৷’’ কিন্তু সব সত্ত্বেও কোল ম্যার্কেলকে কোনোদিনই ক্ষমা করেননি৷ কোল-এর বিধবা স্ত্রী মাইকে কোল-রিশটার-এর বিবৃতি অনুযায়ী, ম্যার্কেল যে তাঁর সমাধি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন, কোল নাকি একাধিকবার সে প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন৷
ঐক্য-অনৈক্য
মাইকে কোল-রিশটারের বয়স হেলমুট কোল-এর চেয়ে ৩৪ বছর কম৷ দু'জনের আলাপ কোল-এর শেষ কর্মকালের সময় চ্যান্সেলরের দপ্তরে৷ কোল-এর প্রথম স্ত্রী হানেলোরের মৃত্যুর কয়েক বছর পরে উভয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয় ২০০৮ সালে৷ কোল তখন হুইলচেয়ারে বসা ও তাঁর বাকশক্তিও অংশত ব্যাহত হয়েছে৷ পরিবারের অন্য সদস্যরা সেই বিবাহে উপস্থিত থাকেননি৷
কোল-রিশটার যা চাননি, ঠিক তা-ই ঘটতে চলেছে৷ প্রথম ইউরোপীয় রাজনীতিক হিসাবে পয়লা জুলাই স্ট্রাসবুর্গের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে হেলমুট কোলের জন্য যে শোকানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে, সেখানে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লোদ ইয়ুঙ্কার ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ছাড়া বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেলও ভাষণ দেবেন৷
কোলকে ইতিহাস কিভাবে স্মরণ করবে?
01:58
মাইকে কোল-রিশটার চেয়েছিলেন যে, হেলমুট কোলের আরেক বিশ্বস্ত, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান কোলের শোকানুষ্ঠানে ভাষণ দিন, কিন্তু তা-ও ঘটছে না৷ অর্বানের ইইউ-বিরোধী মনোভাব ও উদ্বাস্তু নীতির ক্ষেত্রে তাঁর অসহযোগিতা ব্রাসেলসের চোখ এড়ায়নি৷ অপরদিকে হেলমুট কোল জার্মানি তথা ইউরোপকে একতাবদ্ধ করায় তাঁর অবদানের কারণেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন৷
মনে রাখা দরকার, জার্মানিতে হেলমুট কোলের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় শোকানুষ্ঠান হচ্ছে না, যা কিনা একজন পরলোকগত চ্যান্সেলরের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব৷ এছাড়া কোল-এর বাসস্থান লুডভিগসহাফেনের ফ্রিজেনহাইম সমাধিক্ষেত্র, যেখানে তাঁর প্রথম স্ত্রী হানেলোরে শায়িত, সেখানে কোলকে সমাধিস্থ না করে, তাঁর মরদেহ স্ট্রাসবুর্গ থেকে হেলিকপ্টারে করে ও নদীপথে স্পায়ারে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সেখানে ক্যাথিড্রালের পাশে সমাধিস্থ করা হবে তাঁকে৷
কোল তাঁর প্রথম বিবাহের সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করেছিলেন৷ এমনকি নাতিদের সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না৷ তাঁর চরিত্রের এই দু'টি দিক – তাঁর ঐক্য ও অনৈক্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন৷ কিন্তু জার্মান তথা বৃহত্তর ইউরোপীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একতা, একীকরণ এবং ঐক্যবদ্ধতার একটি শক্তি – সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না৷