আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, সুষমা এই সফরে একটি বার্তা নিশ্চিত করে গেছেন৷ আর তাহলো বাংলাদেশের একক কোনো দলের সঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশের দুই বড় দলের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক রাখতে চান তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে ড. আহমেদ বলেন, ‘‘এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বার্তা দিয়েছে ভারত৷ যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ৷ এর মাধ্যমে সুষমা স্বরাজের এই সফরে পরিষ্কার হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন৷''
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
তবে তিনি মনে করেন, সুষমার এবারের সফর একদমই শুভেচ্ছা সফর৷ তিনি ভারতের যে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই সরকার কেবলমাত্র একমাস হলো ক্ষমতায় আসীন হয়েছে৷ আর একমাস বয়সি একটি সরকারের পক্ষে চাইলেও এখনই বড় কিছু করা সম্ভব নয়৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম শাহেদুজ্জামান অবশ্য মনে করেন, সুষমার এই সফরে বাংলাদেশের কোন প্রাপ্তি নেই৷ যা প্রাপ্তি তার সবই ভারতের৷ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে৷
ডয়চে ভেলেকে শাহেদুজ্জামান বলেন, ‘‘তিস্তার পানি চুক্তি, সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে কোন আশ্বাসই দেননি সুষমা৷ তিনিও আগের সরকারের মতো অযুহাত দেখাচ্ছেন৷''
‘খালেদার দেখা করা ঠিক হয়নি'
এম শাহেদুজ্জামান মনে করেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া হোটেলে গিয়ে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করা ঠিক হয়নি৷ খালেদা জিয়াকে নয়-ছয় করে কিছু সময় দিয়েই সুষমা সংসদ ভবনে চলে গেলেন তথাকথিত বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে করতে৷ এতে বোঝা যায় বিএনপি নেত্রীকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন৷
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ অবশ্য মনে করেন, সুষমার সফরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয়েছে৷ তাহলো বাংলাদেশের কোন নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না ভারতের নতুন সরকার৷ যেমনটি কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল৷ সেখান থেকে সরে গিয়ে বিজেপি সরকার বলতে চাচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হবে৷
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১৫৩টি আসনে একক প্রার্থী থাকায় রবিবার অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণ হয়নি৷ নির্বাচনের দিনের কিছু ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Mamunদশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল করতে সরকার ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি গ্রহণ করে৷ এজন্য ৫৯ জেলায় বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় সাড়ে চার লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়৷ বাকি পাঁচটি জেলায় নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি৷
ছবি: DW/M. Mamunভোটার না থাকায় ঢাকার মিরপুরের হাজী আশ্রাফ আলী হাইস্কুলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অলসভাবে সময় কাটাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamunঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাকাডেমি ভোটকেন্দ্রের ছবি এটি৷ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে ভোটারদের জন্য বাঁশ ও দড়ি দিয়ে নির্ধারিত স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে৷ কিন্তু ভোটার নেই৷
ছবি: DW/M. Mamunছবিটি হারম্যান মাইনার কলেজ কেন্দ্রের৷ পাশাপাশি স্থাপিত কয়েকটি বুথ যেন খাঁ-খাঁ করছে৷ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ, জানিপপ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে জানান, ভোটার উপস্থিতি কম হবে এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ এটি একটি ভিন্ন ধরনের নির্বাচন৷ একতরফার সঙ্গে আছে ব্যাপক সহিংসতা এবং বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ৷
ছবি: DW/M. Mamunনির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে ভোটার তালিকায় নাম খুঁজে না পেয়ে অনেক ভোটার ফিরে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ তবে কেউ কেউ অবশ্য কষ্টটা শিকার করেই ভোট দিয়েছেন৷ ছবিতে মিরপুরের একটি কেন্দ্রে ভোটারদের সিরিয়াল নম্বর খুঁজতে দেখা যাচ্ছে৷ তাঁদের সহায়তা করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা৷
ছবি: DW/S. Kumar Deyভোট দিচ্ছেন একজন ভোটার৷ অবশ্য তাঁর মতো ভাগ্যবান হতে পারেননি দেশের মোট ভোটারের শতকার ৫২ জন৷ অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এসব ভোটারের ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না৷ এই কারণে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীও ভোট দিতে পারেননি৷
ছবি: DW/M. Mamunঢাকার একটি কেন্দ্রে ভোট প্রয়োগের অপেক্ষায় কয়েকজন নারী ভোটার৷
ছবি: DW/M. Mamunআব্দুল হাকিম নামে ৮৯ বছরের এই ভোটার দুই ব্যক্তির সহায়তায় ঢাকার একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: DW/M. Mamunদুজন ভোটার ভোট দিতে যাচ্ছেন৷ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় সেখানে ছিলেন সেনা সদস্যরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
তিনি বলেন, ‘‘সেমিনারে দেয়া সুষমার বক্তব্য তাত্পর্যপূর্ণ৷ সেই বক্তব্যে সুষমা বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহনশীলতার সংস্কৃতি, অংশগ্রহণ ও ভিন্নমতের বিকাশ প্রয়োজন৷ অনুরোধ পেলে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা ও অনুসৃত আদর্শ সানন্দে বিনিময় করব৷''
‘সংলাপ হয়তো শুরু হতে পারে'
আশাবাদী ড. আহমদে বলেন, ‘‘এখন দেখা দরকার যে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে কোন পরিবর্তন আসে কি-না৷ আমি আশাবাদী, এক ধরনের সংলাপ হয়তো শুরু হতে পারে৷ আওয়ামী লীগের এখন উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শুরু করে দেয়া৷''
এম শাহেদুজ্জামান অবশ্য মনে করেন, ভারতের কোন আশ্বাসের দিতে তাকিয়ে থাকা বিএনপির ঠিক হবে না৷ বিএনপির উচিত্ জনগনের প্রতি আস্থা রেখে আন্দোলন, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া৷ কারণ এর আগেও ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখেনি৷ বরং তারা আমাদের কাছ থেকে ট্রানজিটসহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে৷ তারা পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছে আমাদের সম্পর্ককে খুবই নেতিবাচক কথা বলে৷
তিনি বলেন, ‘‘সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক করবে না৷ তারা তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবে৷''