প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়৷
২২টি দেশের মেয়েদের নিয়ে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ অল্প বয়সি মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো না কোনোভাবে নিপীড়ন বা হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে ফেসবুকে, এর পরে রয়েছে ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং স্ন্যাপচ্যাট৷
অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Getty Images/AP/Chung Sung-Junজাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন৷ এছাড়া নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউস’-এ অভিনয় করেছেন তিনি৷ এ বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা৷ অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি৷ কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoliদক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন৷ মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি৷ তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন৷ অর্থাৎ, মেয়েদের বক্ষবন্ধনী না পরার পক্ষে ছিলেন সল্লি৷ এ কারণে তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে৷ এসবের কারণে হতাশায় ভুগে গতবছর অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Yonhapদক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ ব্যান্ড ‘খারা’র সদস্য খু হারা গতবছর নভেম্বরে আত্মহত্যা করেন৷ তিনিও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন৷ তার সাবেক প্রেমিক বিনা অনুমতিতে ধারণ করা তাদের যৌন মিলনের ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিলে মামলা করেছিলেন খু হারা৷ এরপর ঐ ভিডিও প্রকাশিত হলে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ ভালো বন্ধু সল্লির মাসখানেক পর আত্মহত্যা করেন খু হারা৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCYক্যানাডার ১৫ বছর বয়সি টড সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১২ সালে আত্মহত্যা করে৷ তার আগে ইউটিউবে সে একটি ভিডিও পোস্ট করে৷ অ্যামান্ডা জানায়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভিডিও চ্যাট করতে গিয়ে একজনে সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ একসময় সে তাকে তার খোলা বুক দেখাতে রাজি করায়৷ এরপর সেই ছবি বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ পরে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশও করা হয়৷ এই ঘটনায় অ্যামান্ডাকে কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpaপিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার স্কুল শিক্ষার্থী রূপা (১৬) গত বছর আগস্টে আত্মহত্যা করে৷ পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রের উল্লেখ করে প্রথম আলো জানায়, তামিম খান (১৮) নামে একজন রূপাকে তার সঙ্গে প্রেম না করলে আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ রূপার বাবার দাবি, তার মেয়ের ছবি ফটোশপ করে তামিম বিভিন্নজনের কাছে ছড়িয়েছে৷ তাই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে৷
ছবি: Klicksafe/M. Kusch১৫ বছরের অস্ট্রেলীয় এই শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করে৷ এরপর অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Akubra Hatsযুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মেসা শহরের দশ বছর বয়সি মারিয়ান হার্নান্দেজ রোখাস সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছে৷ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সে এ কাজ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক’ জানিয়েছে৷ মোবাইলে তাকে নানারকম বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো বলে জানিয়েছে রোখাসের বন্ধুরা৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Byrneমাইকেল জ্যাকসনের মেয়ে প্যারিস জ্যাকসন তার চেহারা নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন৷ সে কারণে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন বলে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতার বিষয়টি ভালো৷ কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের জাতির জনকেরা যখন সংশোধনী (সংবিধানে) রচনা করছিলেন তখন সামাজিক মাধ্যমের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি৷’’
ছবি: Getty Images/N. Barnardতামিল অভিনেত্রী বিজয়লক্ষ্মী সম্প্রতি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ তামিল নায়ক কাম রাজনীতিবিদ সীমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন তিনি৷ তার অভিযোগ, সীমান তাকে বিয়ের অঙ্গীকার করেছিলেন৷ আত্মহত্যার জন্য বিপি ট্যাবলেট খেয়েছেন জানিয়ে ২৬ জুলাই রাতে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করেন বিজয়লক্ষ্মী৷ তিনি অভিযোগ করেন, সীমানের দলের লোকেরা কয়েকমাস ধরে অনলাইনে তাকে হয়রানি করেছে৷ সেজন্য তিনি প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaগতবছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে৷ এদিকে, গতবছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা জানান, ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷
ছবি: DW/A. Islam প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত এই সমীক্ষায় ২২টি দেশের ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সি মোট ১৪,০০০ মেয়ে অংশ নিয়েছে ৷ গবেষকরা ভুক্তভোগী অনেকের খুঁটিনাটি বিষয়ে সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন ৷ জরিপে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল, বেনিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতও রয়েছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার যারা হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৩৯ জন ফেসবুকে এবং বাকিরা ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার ও টিকটকের মাধ্যমে৷
আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার, বিব্রতকর কথাবার্তার কারণে অনেকে স্যোশাল মিডিয়ার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে বা খুবই কম ব্যবহার করছে৷ অংশগ্রহণকারীদের ২২ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে স্যোশাল মিডিয়া থেকে দূরে সরে গেছেন৷ সংখ্যালঘু, জাতিগত বৈষম্য বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়রানির ঘটনা অনেক বেশি ঘটে থাকে বলেও গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে৷
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সিইও অ্যান-বির্গিট আলব্রেক্টসেন বলেন, ‘‘অনলাইনে হয়রানি শারীরিকভাবে না হলেও এতে মেয়েরা ভয়ে থাকে, যা তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে৷’’ তাঁর মতে, মেয়েদের নিজেদেরই আত্মবিশ্বাসের সাথে অনলাইন সহিংসতাকে মোকাবেলা করতে হবে৷
যদিও ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম এ ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছে৷ তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোনো কিছুই এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের হয়রানি বন্ধ করতে পারেনি৷
টানিকা গডবোল/এনএস