এখনও নট আউট!
১৫ জুলাই ২০১৩কেউ কখনও ভেবে দেখেছেন, কলকাতা শহরের দৈর্ঘ বা বিরাটত্ব বোঝাতে কেন টালা থেকে টালিগঞ্জ বলা হতো? আসলে উত্তর দিকে শহরটার ব্যাপ্তি কিন্তু আরও বেশি৷ সেই বরানগর পার করে ডানলপ পর্যন্ত৷ অথবা নেহাতই যদি এত দূর এগোতে না হয়, তা হলে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়েই সীমানা টেনে দিলে হতো! খামোকা ‘‘টালা'' কেন! একটি মাত্র কারণে৷ বেলগাছিয়ার লাগোয়া ওই টালা নামক জায়গাটিতেই সেই অতিকায় জলাধারটি রয়েছে, যে জলাধার গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলকাতা শহরের জলপিপাসা মিটিয়ে চলেছে৷
বয়সের সঠিক হিসেব করলে ১০৪ বছর৷ ২০০৯ সালে কলকাতা পুরসভার তরফ থেকে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই টালা ট্যাংকের শতবর্ষ পালন করা হয়৷ এই ১০৪ বছরে মাত্র ১৪ বার ট্যাংকটির ‘লিক' সারাতে হয়েছে৷ ফুটবল মাঠের থেকেও বড়, দশতলা বাড়ির সমান উঁচু এই ট্যাংকে লিক না হওয়াটাই কিন্তু আশ্চর্যের৷ কারণ, অগুনতি লোহার খুঁটির উপর দাঁড় করিয়ে রাখা এই ট্যাংকের গর্ভে জল ধরে ৯০ লক্ষ গ্যালন৷ সেই বিচারে এটিই সারা পৃথিবীতে সবথেকে বড় ‘ওভারহেড' জলের ট্যাংক৷ এবং অনেক দিক দিয়েই টালার ট্যাংক ঐতিহাসিক৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা শহর আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিল, পাছে জাপানি বোমারু বিমান তাদের সহজ লক্ষ্য হিসেবে অতিকায় বর্গাকার ওই ট্যাংককেই না বেছে নেয়৷ কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ফাঁড়া কাটিয়ে উঠেছিল টালার ট্যাংক৷
শুনলে হয়ত মজাই লাগবে যে কলকাতা শহরে লাল দীঘি থেকে শুরু করে মনোহর দাস তড়াগ, কলেজ স্কোয়্যার বা হেদুয়া, যে কটা বড় জলাশয় রয়েছে, সবকটাই খোঁড়া হয়েছিল, না, সৌন্দর্যায়নের জন্য নয়, শহরের জলের প্রয়োজন মেটাতে৷ ঠিক যেভাবে গ্রামাঞ্চলে জলের চাহিদা মেটাতে পুকুর খোঁড়া হয়৷ কিন্তু শহর ক্রমশ যত বাড়তে লাগল, যত তার লোকসংখ্যা বাড়ল, ততই পানীয় জলের নতুন উৎস খুঁজতে উদ্যোগী হলো পুর প্রশাসন৷ ১৮২০ সালে প্রথম একটা ছোট পাম্পিং স্টেশন তৈরি হল হুগলি নদীর ধারে, চাঁদপাল ঘাটে৷ সেখান থেকে নদীর জল তুলে সিমেন্টের খোলা নালা দিয়ে পাঠানো হত শহরের নানা জায়গায়৷ পুরনো কলকাতার অনেক বাড়িতেই তখন বসেছিল ‘‘গঙ্গা কল''৷ জল বা পানি যেত চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট, লালবাজার অঞ্চলে, আর উত্তরে বউবাজার, চিৎপুর রোডের কিছু অংশ এবং টালা পর্যন্ত৷ জেসপ কোম্পানি মাসিক ৪০০ টাকার চুক্তিতে দিনে সাত ঘণ্টা পাম্প চালিয়ে জল সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল৷ জল তোলা হতো নদীতে ভাঁটার সময়৷
কিন্তু সমস্যা হলো, সারা বছর নদীর জল রান্না কিংবা খাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেত না৷ এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে যতদিন না বর্ষা আসছে, নদীর জলে নুনের ভাগ বেড়ে যেত৷ ফলে পরিশ্রুত জলের একটা চাহিদা থেকেই যাচ্ছিল৷ তখন ব্রিটিশ সরকার ড. ম্যাকনামারা বলে এক বিশেষজ্ঞকে দিয়ে কাশীপুর, চুঁচুড়া ও পলতায় হুগলি নদীর জল পরীক্ষা করে, পরিশ্রুত জল তোলার আদর্শ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করল পলতাকে৷ ১৮৬৮ সালে ওই পলতাতেই ৪৮২ একর জমি জুড়ে পুরসভার প্রথম জল পরিশোধনের প্রকল্প তৈরি শুরু হল৷ একটা সময় এই পলতা প্রকল্পের দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা দাঁড়াল ৬০ লক্ষ গ্যালন জল৷
কলকাতার লোকসংখ্যা তখন চার লক্ষ এবং প্রতিদিনই সংখ্যাটা বাড়ছে৷ পলতা প্রকল্প থেকে আসা পরিশুদ্ধ জল ধরে রাখার জন্য ১৯০৯ সালে শুরু হলো টালার ওই প্রকাণ্ড জলাধারটি তৈরির কাজ৷ একই প্রয়োজনে, একই সঙ্গে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে একটি ভূগর্ভস্থ জলাধার তৈরির কাজও শুরু হলো৷ আর এর পাশাপাশি মাটির নীচে জলের পাইপ বসানোর কাজ শুরু হল৷ টালার ট্যাংকের সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেল শহর কলকাতা৷ অবশ্য সেভাবে কখনও শহরের বা নাগরিক জীবনের ‘আইকন' হয়ে উঠতে পারেনি অদ্ভুতদর্শন, অতিকায়, জরদগব এই জলাধার৷ কিন্তু টালার ট্যাংক ওই স্থানুবৎ না দাঁড়িয়ে থাকলে আক্ষরিক অর্থেই শুকিয়ে মারা যেত কল খুললেই জল পাওয়ার শহুরে আয়াসে অভ্যস্ত কলকাতা৷
টালার ট্যাংকের মেরামতি পুরসভার বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যে আজও সহজ কাজ নয়৷ যে কারণে রাইটস বলে রেল বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা প্রথমে একটি স্টেটাস রিপোর্ট তৈরি করে দেবে পুরসভাকে৷ বিশাল ট্যাংকটির ১৬ ফুট গভীর খোলটি লম্বা-চওড়ায় নির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত৷ প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভিতরের সেই পার্টিশনের রিভেট করা জোড়গুলো দূর্বল হয়ে গিয়েছে৷ এবার আরও বিস্তারিত পরীক্ষা চলছে, যা শেষ হলে মেরামতির প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হবে৷ তবে পুরসভার উদ্দেশ্য স্পষ্ট৷ শতাব্দীপ্রাচীন এই জলাধারকে এখনই অবসরে পাঠানো হবে না৷ তৃষ্ণা এখনও মেটেনি কলকাতার!