পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ব্রেওনার। মেয়র তাঁর পরিবারের হাতে ১২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ তুলে দিলেন।
বিজ্ঞাপন
ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কথা জানালেন অ্যামেরিকার কেনটাকি অঞ্চলের লুইভিলের মেয়র। গত মার্চ মাসে লুইভিলের পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল কৃষ্ণাঙ্গ ব্রেওনা টেলরকে। মেয়র গ্রেগ ফিশার মঙ্গলবার জানান, ওই হত্যার জন্য ব্রেওনার পরিবারের হাতে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে দেওয়া হবে। অ্যামেরিকার ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনে ঢালাও সংস্কার হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার আগে যা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে
00:59
এ বছর মার্চ মাসে ব্রেওনা টেলরের বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছিল পুলিশ। ২৬ বছরের ব্রেওনা তাঁর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকতেন। কাজ করতেন একটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। পুলিশের দাবি, ড্রাগ রয়েছে এই সন্দেহেই তাঁদের বাড়িতে আচমকা ঢুকে পড়া হয়েছিল। এমন ভাবে পুরো ঘটনাটি ঘটে যে, ব্রেওনার বয়ফ্রেন্ড একবার গুলি ছোড়েন। কারণ তিনি বুঝতে পারেননি বাড়িতে পুলিশ ঢুকেছে। তাঁরা দুই জনেই ভেবেছিলেন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। ব্রেওনার বয়ফ্রেন্ড একবার গুলি ছুড়তেই পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। পর পর আটটি গুলি লাগে ব্রেওনার। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ঘিরে তত দিনে উত্তাল হয়ে গিয়েছে অ্যামেরিকা। তারই মধ্যে ব্রেওনার ঘটনায় উত্তাপ আরও ছড়ায়। দীর্ঘ দিন ধরে কেনটাকির বিভিন্ন অঞ্চলে ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স আন্দোলন হয়েছে।
আফ্রো-অ্যামেরিকান যে ব্যক্তিদের কথা অবশ্যই জানা উচিত
যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের বিদ্বেষ ও নির্যাতনের ইতিহাস বহু পুরনো৷ এখানে কয়েকজন আফ্রো-অ্যামেরিকান ব্যক্তির কথা তুলে ধরা হলো, যাদের নাম গত তিনশ বছরের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
ক্রিসপাস অ্যাটাকস (১৭২৩-১৭৭০)
তাঁর জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্র বলে কোনো দেশ ছিল না৷ ১৭৭০ সালের ৫ মার্চ ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যে পাঁচ বেসামরিক মানুষ নিহত হন তিনি তাদের একজন৷ এটি ‘বস্টন হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত৷ অ্যামেরিকান বিপ্লবে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ শহিদ হিসেবে সমাদৃত৷ তার বাবা আফ্রিকান এবং মা ভারতীয়৷ তিনি একজন পলাতক ক্রীতদাস ছিলেন৷
ছবি: Gemeinfrei
বেনজামিন ব্যানেকার (১৭৩১-১৮০৬)
এই গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত৷ তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলুপ্ত করার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের সমালোচক ছিলেন, যিনি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মানসিকতাকে নিকৃষ্ট ভাবতেন৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Highsmith
ফিলিস হুইটলে (১৭৫৩-১৭৮৪)
আফ্রিকায় জন্ম নেয়া এই নারীকে মাত্র সাত বছর বয়সে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল৷ তিনি তার মালিকের কাছে লেখাপড়া শিখেছিলেন৷ ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ১৭৭৩ সালে তিনি প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান হিসেবে কবিতা সংকলন বের করেন৷ জর্জ ওয়াশিংটন তার কবিতার প্রশংসা করে বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media
জেমস ফোর্টেন (১৭৬৬-১৮৪২)
সমুদ্র দেখা এবং জাহাজের পাল তৈরিতে প্রশিক্ষণ নেয়ার শখ ছিলো ফিলাডেলফিয়ার জেমস ফোর্টেনের৷ ১৭৯৮ সালে পাল তৈরির যে কারখানায় তিনি শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তা কিনে নেন এবং ধনী হয়ে ওঠেন৷ ক্রীতদাস বহনকারী কোনো জাহাজে তিনি পাল বিক্রি করতেন না৷ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার অর্থ-সম্পদকে কাজে লাগিয়েছিলেন৷ সর্বকালের সেরা একশ আফ্রো-অ্যামেরিকানের তালিকায় তার নাম আছে৷
ছবি: public domain
সোজার্নার ট্রুথ (১৭৯৭-১৮৮৩)
ইসাবেলা বোমফ্রি নামে ক্রীতদাস হিসেবে জন্ম৷ ১৮২৭ সালে সন্তানসহ পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল তাকে৷ দাসপ্রথার অবসান এবং নারী অধিকার নিয়ে আইনি লড়াই লড়েছেন, সেসময় তার নতুন নাম হয় সোজার্নার ট্রুথ৷ ১৮৫১ সালে বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে তার বিখ্যাত বক্তব্য ছিল ‘আমি কি নারী নই?’ তিনি যৌনাঙ্গচ্ছেদেরও বিরোধিতা করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
মারিয়া ডাব্লিউ স্টুয়ার্ট (১৮০৩-১৮৭৯)
মুক্ত মানুষ হিসেবে জন্ম৷ একাধারে সাংবাদিক, মৃত্যুদণ্ডবিলোপপন্থি, প্রভাষক এবং নারী অধিকার আইনজীবী৷ তিনিই প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান, যিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষাঙ্গ নারী-পুরুষের সামনে বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘‘গায়ের রং নারী-পুরুষ নির্ধারণ করে না, আত্মা যে নীতির দ্বারা গঠিত, তা নির্ধারণ করে৷’’
ছবি: Gemeinfrei
হ্যারিয়েট টাবম্যান (১৮২০-১৯১৩)
১৮৪৯ সালে মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে যান ক্রীতদাস হ্যারিয়েট৷ ‘পাতাল রেলের কন্ডাকটার’ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন৷ আসলে ক্রীতদাসদের মুক্ত করতে ‘সেফ হাউজ’ তৈরি করতেন তিনি৷ পরবর্তীতে দরিদ্র ক্রীতদাসদের সাহায্য করতেন তিনি৷ ক্রীতদাস ব্যবসায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের বদলে ২০ ডলারের নোটে টাবম্যানের ছবি ব্যবহার করা হবে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
বুকার টি ওয়াশিংটন (১৮৫৬-১৯১৫)
গৃহযুদ্ধ তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল৷ তিনি ছিলেন প্রভাবশালী শিক্ষক, লেখক এবং অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা৷ আফ্রিকান-অ্যামেরিকানদের শিক্ষার মাধ্যমে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের মানোন্নয়নের পরামর্শ দিতেন তিনি৷ তিনিই প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান যিনি ১৯০১ সালে কোনো প্রেসিডেন্টের সাথে খাবার খেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
আইডা বি ওয়েলস-বার্নেট (১৮৬২-১৯৩১)
গৃহযুদ্ধের আগে ক্রীতদাস ছিলেন বাবা-মা৷ তিনি একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল’ বা এনএএসিপি-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা৷
ছবি: Imago Images
জেমস ওয়েলডন জনসন (১৮৭১-১৯৩৮)
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান অধ্যাপক, যিনি প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের অধীনে কূটনীতিক ছিলেন৷ তিনি এনএএসিপি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন৷ বর্ণবিদ্বেষ এবং কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন৷ তার লেখা কবিতা ‘লিফট এভরি ভয়েস অ্যান্ড সিং’ পরবর্তীতে ‘আফ্রো-অ্যামেরিকান জাতীয় সংগীতে রূপ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
ডাব্লিউ ই বি ডু বোইস (১৮৬৮-১৯৬৩)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যিনি একাধারে এনএএসিপি’র প্রতিষ্ঠাতা, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ এবং নাগরিক অধিকার কর্মী৷ ১৮৯৫ সালে তিনি ওই ডিগ্রি পান৷ দাস-বাণিজ্যের উপর তিনি থিসিস লিখেছিলেন৷ মেধাবী শিক্ষার্থী হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি৷ ১৯১৯ সালে প্যারিসে প্রথম ‘এক্সিবিট অফ অ্যামেরিকান নিগ্রোস’ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷
ছবি: picture-alliance/Glasshouse Images
রোজা পার্কস (১৯১৩-২০০৫)
১৯৫৫ সালে একটি বাসে শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির জন্য নিজের আসন ছাড়তে রাজি না হওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে৷ এই ঘটনা ‘মন্টগামরি বাস বয়কট’ আন্দোলনে রূপ নেয়৷ এর সূত্র ধরে মার্টিন লুথার কিং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হন৷ ‘নাগরিক অধিকারের প্রথম নারী’ এবং ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের জননী’ হিসেবে অমর হয়ে আছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/Everett Collection
12 ছবি1 | 12
মঙ্গলবার ব্রেওনার মায়ের হাতে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেক তুলে দিয়েছেন মেয়র। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, পুলিশ প্রশাসনে বড় রকমের সংস্কার হবে। আর ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশ কারও ঘরে সার্চ করতে ঢুকতে পারবে না।
ব্রেওনার মা অবশ্য জানিয়েছেন, শুধু টাকা পেয়ে আর আশ্বাস পেয়ে তিনি খুশি নন। তিনি চান ব্রেওনাকে যাঁরা মেরেছেন, সেই পুলিশ অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। বস্তুত, ইতিমধ্যে ওই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস শুরু হয়েছে। মেয়র জানিয়েছেন, এই প্রথম এ ধরনের ঘটনায় এত পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলো। তাঁর বক্তব্য, মঙ্গলবার ওই মামলার প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্রেওনার পরিবার যাতে সব দিক থেকে বিচার পায়, তা দেখার দায়িত্ব তাঁর।