ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ২০টিরও বেশি প্রতিমা ভাঙা হয়েছে৷ শনিবার রাতে একে একে তিনটি ইউনিয়নের ১৪টি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙা হলেও পুলিশ আসেনি৷ ঘটনায় জড়িতদের একজনকেও এখনো গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ৷
বিজ্ঞাপন
পুলিশ বলছে, এই ঘটনা পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলক৷ যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে৷
কয়েকদিন আগে লক্ষ্মীপুজা হয়ে গেছে৷ সামনে আর কোনো বড় পূজা নেই৷ এমন সময়ে এতগুলো মন্দিরে হামলা চালালো কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী?
স্থানীয়রা জানান, শনিবার গভীর রাত থেকে রবিবার ভোর রাতের মধ্যে ১৪টি মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো হয়েছে৷ যারা করেছেন তারা একই সময়ে একযোগে এটা করেছেন বলে ধারণা করছেন তারা৷
উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন ধনতলা, চাড়োল ও পাড়িয়া ইউনিয়নের গ্রামের মন্দিরে এসব ভাঙচুর চালানো হয়৷ এই তিনটি ইউয়িনের সংযোগস্থলে মন্দিরগুলো৷ পাশেই লাহিড়ী হাট নামে একটি বাজার আছে৷
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিদ্যানাথ বর্মন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধনতলা ইউনিয়নে ৯টি, চাড়োল ইউনিয়নে একটি এবং পাড়িয়া ইউনিয়নে চারটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷”
ব্যক্তি নয়, সম্প্রদায়কেই তারা টার্গেট করেছে: বিদ্যানাথ বর্মন
তিনি আরো বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় মন্দির ধনতলার সিন্দুর পিন্ডির মন্দিরের আটটি প্রতিমার সবকটিই ভেঙে ফেলা হয়ছে৷ তার উত্তর দিকে দুইটি মন্দিরের দুইটি প্রতিমা ভাঙা হয়েছে৷ এখানেই ভাঙা হয়েছে ১০টি প্রতিমা৷”
এই ইউনিয়নে পাঁচটি মনসা মন্দির, একটি লক্ষ্মী মন্দির ও একটি কালী মন্দিরের প্রতিমাও ভাঙা হয়েছে৷ পাড়িয়া ইউনিয়নে একটি বুড়া-বুড়ি মন্দির, একটি লক্ষ্মী মন্দির, একটি আমাতি মন্দির এবং একটি মাসানমাঠ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷ এছাড়া চাড়োল ইউনিয়নে একটি কালীমন্দিররের প্রতিমাও ভাঙা হয়েছে৷
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিদ্যানাথ বর্মন জানান, প্রতিমাগুলোকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে৷ কিছু প্রতিমা ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে৷
বিদ্যানাথ বর্মন আরো বলেন, ‘‘আমার জানা মতে অতীতে আমাদের এই এলাকায় এই ধরনের হামলার ঘটনা কখনোই ঘটেনি৷ ধনতলা ইউনিয়নটি হিন্দু অধ্যুষিত৷ এই এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক মন্দির আছে৷ এর আগে কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি৷”
তিনি বলেন, ‘‘যারা এটা করেছেন, আমার মনে হয় কোনো ব্যক্তি তাদের টার্গেট নয়, সম্প্রদায়কেই তারা টার্গেট করেছে৷ এটা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ৷ তবে কারা করেছে তা আমরা বুঝতে পারছি না৷ আমি নিজেও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ ঘটনার সময় কেউ দেখেছে- এখনো এমন কাউকে পাইনি৷”
বিদ্যানাথ বর্মন জানান, ‘‘এখন র্যাব ও পুলিশ টহল দিচ্ছে৷ তারা তদন্ত করছে৷ তবে আমরা আতঙ্কে আছি৷ যারা করেছে, তাদের আরো বড় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে পারে৷”
এই হামলা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক: মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন
জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার ১৪টি মন্দিরের অন্তত ২০টি প্রতিমা ভাঙার বিষয়ে বলেন, ‘‘যেভাবে একই সময়ে একযোগে মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে বিষয়টি সিরিজ বোমা হামলার মতো৷ যারা হামলা করেছেন, তারা একযোগে হামলা চালিয়ে চলে গেছেন৷”
তিনি বলেন, ‘‘অতীতে পূজার সময় বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে৷ কিন্তু এইরকম আগে কখনো ঘটেনি৷”
ঘটনার জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সন্দেহ করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কারা এটা করেছে তা এখনো বুঝতে পারছি না৷ এসপি ও ডিসি সাহেব এলাকা ঘুরে গেছেন৷ পুলিশ তদন্ত করছে৷ হয়তো জানা যাবে৷”
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মামলা হয়েছে কিন্তু এখনো কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা জোর দিয়ে তদন্ত করছি৷ আশা করছি. সবকিছু স্পষ্ট হবে৷ তবে এটা পরিস্কার যে, এই হামলা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক৷” ওই এলাকায় কোনো সিসি ক্যামেরা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পাশের বাজারে আছে, কিন্তু যেসব এলাকায় মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে সেই এলাকায় নেই৷ আর ওই মন্দিরগুলোতে রাতে কেউ থাকেন না৷”
দায়ীদের আইনের আওতায় আনার ওপর জোর দিচ্ছি: মো. মাহবুবুর রহমান
এখন পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হলেও ওই এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন৷ এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে৷
তবে ঠাকুরগাঁও জেলার ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মো. মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়৷ তবে আতঙ্কের মতো কোনো পরিস্থিতি নেই৷ ঘটনার পরই পুলিশ সুপারকে নিয়ে এলাকায় গিয়েছি৷ আমাদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও ছিলেন৷ আমরা ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে আছি৷”
তার কথা, ‘‘আমরা এথন কারা এটা ঘটিয়েছে তা বের করে তাদের আইনের আওতায় আনার ওপর জোর দিচ্ছি৷ পুলিশ কাজ করছে৷ আর ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়েও আমরা কাজ করছি৷” তিনি বলেন, ‘‘ওই এলকায় অতীতে এই ধরনের ঘটনার কোনো নজীর নেই৷ তাই কারা কোন স্বার্থে এটা করেছে তা আমরা জানার চেষ্টা করছি৷”
২০২১ সালের ছবিঘরটি দেখুন...
হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা পরিক্রমা
কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে৷ ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি কোরআনটি সেখানে রেখেছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
কুমিল্লায় শুরু
১৩ অক্টোবর বুধবার দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে সকাল ১১টায় প্রথম হামলা হয়৷ এর আগে সকালে পূজা মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধার করেন কোতোয়ালী থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম৷ কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
অন্যান্য জেলায় হামলা
কুমিল্লা ছাড়াও একইদিন চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ভোলা, চট্টগ্রাম, ও কক্সবাজারে হামলা হয়েছে বলে ১৬ অক্টোবর জানায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ৷ এছাড়া ১৪ অক্টোবর বান্দরবান ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটে৷ আর ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে হামলা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দিনে ৭০ মণ্ডপে হামলা
১৬ অক্টোবর শনিবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ এসবের বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
ফেনীতে হামলা
মন্দিরে মণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল৷ ফেনীতে সেই কর্মসূচির প্রস্তুতি চলার সময় হামলা হয়৷ এরপর শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়৷ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দুদের মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকানপাটে ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া যায়৷ বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফেনীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
রংপুরের পীরগঞ্জে হামলা
১৭ অক্টোবর রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লির হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়৷ হামলাকারীরা ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে৷
ছবি: bdnews24.com
নয় বছরে ৩,৬৭৯ হামলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা৷ ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা৷ আর প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি৷ এসব হামলায় আহত হয়েছেন ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ নিহত হয়েছেন ১১ জন৷
ছবি: Tarun Chakraborty Bishnu
প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে৷ শাহবাগের আন্দোলনকারীরা তিন দফা দাবি পূরণ করতে সরকারকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন৷ দাবিগুলো হলো, দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দোষীদের বিচার; ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহত ও নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
হিন্দুদের প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ১৮ অক্টোবর সোমবার হিন্দুদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ
কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন কয়েকশ মানুষ৷ কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ের কাছে পুলিশ বাধা দিলে মিছিলকারীরা দুই ভাগ হয়ে যান৷ তাদের একটি অংশ বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে শুরু করে৷ পুলিশ তখন বিভিন্ন গলির মুখে অবস্থান নেয় এবং টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোঁড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিক্ষোভ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে প্রায় দশ হাজার মুসলিম ১৬ অক্টোবর শনিবার বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তারা এই বিক্ষোভ করেন৷
ছবি: Abdul Goni/AP Photo/picture alliance
মাশরাফির প্রতিক্রিয়া
সোমবার ফেসবুকে পীরগঞ্জে হামলার ছবি শেয়ার করে মাশরাফি লেখেন, এই ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে চুরমার করেছে৷ ‘‘এ লাল সবুজতো আমরা চাইনি৷ কতো কতো স্বপ্ন, কতো কষ্টার্জিত জীবন যুদ্ধ এক নিমিষেই শেষ৷ আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়েত দিন৷’’
ছবি: Facebook
১০২ মামলা, গ্রেপ্তার ৫৮৩
হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ, প্রতিমা ও বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০২টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস৷ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্যও দিয়েছে তারা৷