1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

১৪২৮-এর আগমনে কয়েকছত্র অপ্রেমপত্র

খালেদ মুহিউদ্দীন
১৩ এপ্রিল ২০২১

পঞ্জিকার পাতা উল্টে হোক বা গাছের পাতা পাল্টে প্রতিবছরই বৈশাখ আসে৷ আমরা ঠাকুরের গান গাই, প্রকৃতি পড়ে কাজীর কবিতা৷

Lotusblüte Seerose Teich Lotus Blüte
ছবি: Fotolia/Aamon

বছরজুড়ে এত নতুন যে নতুন বছর আর আবেদন যে তৈরি করে না তা-ও পুরানো হয়ে গেছে৷ সব নতুন সব বদল বলা উচিত বেশির ভাগ নতুন আমাদের জন্য যে শুভ নিয়ে আসে তা তো নয়, আমাদের বুক চিরে তাই শাহ করিমের গান, আহা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! আসলেই কি যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ?

সৃষ্টির শুরু থেকেই অতীত পেছনে ফেলে শুধু স্মৃতিটুকু পাঁজরের হাহাকারে লুকিয়ে দিগন্তরেখা ধরে সামনে হাঁটতে থাকে যারা, তাদের ডাকা হয় মানুষ৷ আর সব প্রাণীকূলের অধিকাংশই ২০ লাখ বছর আগের নিয়মে খায় বা বংশে বাড়ে৷ যতটুকু না পাল্টালে বেঁচে থাকা যাবে না ততটুকু করে অভিযোজন৷ মানুষই শুধু নতুনের স্বপ্ন দেখে, একরকম থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে৷ নতুনের সন্ধানে তাকে কেউ যেন ‘চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া', তাই তার এই পথ চলাতেই আনন্দ৷ চলার পথে মানুষ পরিবার, সমাজ, ইতিহাস বা ঐতিহ্য সব কিছু ফেলে, ছড়িয়ে, পায়ে দলে, ধ্বংস করে আগায়৷ আবার পেছনে তাকিয়ে চোখ মোছে- এটাই তার নিয়তি কিনা বলা মুশকিল, তবে তার নিয়ত যে তা বিভিন্নভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব৷ 

আমাদের জীবনে বাংলা বছরের গুরুত্ব মূলত কৃষকের কর্মপরিকল্পনায় আর পহেলা বৈশাখের বটমূলের পান্তাভাতে৷ বছরজুড়ে খুব সতর্ক লোকেরা জানেন, বাংলা দিনক্ষণ জানতে পত্রিকার প্রথম পাতার প্রথম ভাগ দেখতে হবে৷ আর বাদ বাকি আমাদের জন্য তা চাকরির ইন্টারভিউয়ের খুব চালাক প্রশ্ন৷ তাই খুব ঢাক-ঢোল আর নতুন কাপড়ে বছরটি এলেও আমরা মোটামুটি দিন সাতেকের মধ্যেই ভুলে যাই আজ বৈশাখ, না চৈত্র?

ভুলে যাই তাতে অবশ্য ক্ষতি বা বৃদ্ধি নেই৷ ভুলে যেতে চাইলে বা গেলে আপনি তো আর কোনো আদেশ বা নির্দেশে তা মনে রাখবেন না৷ অথবা রাখবেন, রাখবেন দুটো কারণে৷ মানুষ যখন দল, গোষ্ঠী বা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন থেকেই তার জনপ্রিয় হওয়ার বা থাকার কাঙ্খা আর সমাজ বা গোষ্ঠীচ্যুত হওয়ার ভয়৷ খুব সরলীকরণ করলে বলা যায়, এই অভিলাষ আর এই ভীতিকে পুঁজি করেই রচিত হলো সাম্রাজ্য, উপনিবেশ আর পুঁজিবাদ৷ জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করতে মাও হাতে নিলেন বন্দুকের নল, ম্যাকিয়াভেলি লিখলেন প্রিন্স৷

শাসকদের কথা ছেড়ে আমরা যারা শাসিত তাদের দিকে দেখি একটু৷ আগে যারা একটু বেশি চিন্তা করতেন অন্তত চিন্তার মাদুরখানা পেতে তাতে বসে থাকতেন তারা জনপ্রিয়তার ধার খুব ধারতেন না৷ বলা উচিত একটু যেন উল্টাো স্রোতের কথাই বলতেন৷ আমাদের কালিদাস বা জগতের চিন্তাকূল শিরোমণি সক্রেটিস এইরকম বাঁকা কথার জন্যই খ্যাতিমান৷ আমাদের এখনকার বুদ্ধিজীবীরা মন দিয়ে চলতি খবরের কাগজ পড়েন, তারও বেশি পড়েন নেটে ভেসে বেড়ানো হাজার বা লাখ কমেন্ট, শক্তিশালি নাকে গন্ধ শুঁকে দেখেন কোন দিকে বাতাস৷ গোষ্ঠীচ্যূত হওয়া দূর জনপ্রিয়তায় সামান্য ভাটা যেন না পড়ে তার খেয়াল রাখেন নিষ্ঠার সীমানা পেরিয়ে৷ বেশি মানুষের মনের কথা বলতে পেরেছেন বলে তারা বাহবা পান, ভুলে যান নিজের সীমানা, ঘুম থেকে উঠে বা আধো ঘুমেই লাইক গুণে গুণে জাহান্নামের আগুনে বসেও হাসেন পুষ্পের হাসি৷ যুক্তিতে তারা দারুণ, ধর্মের নামে অন্যায় হলে বলেন ব্যক্তি আর ধর্মকে মেশাবেন না, আবার সাংবাদিকতার সমালোচনা করতে গিয়ে পুরো সাংবাদিকতাকেই বানিয়ে দেন মিথ্যাবাদী৷ তারপর হাততালির শব্দে মেনে নেন অনন্ত বধিরতা৷

খালেদ মুহিউদ্দীন, প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগছবি: DW

অন্যদিকে বেশিরভাগ মানুষের মতামত বা কল্যাণকে গুরুত্ব দিতে গেলে জনপ্রিয়তার সিঁড়ি বেয়ে ঘাড়ে গিয়ে বসতে বা হাত রাখতে হলে এক জীবনে বোধহয় কুলায় না৷ তাই বন্দুকের নলে তেল মাখানো হয় আর উন্নয়নের ডুগডুগিতে চর্বি৷ কিন্তু শুধু ভয় দেখিয়ে, মানে, তেরে মেরে ডান্ডা ঠান্ডা করা একটি প্রাচীন পন্থা৷ দেখা গেছে, সময় এলে জড় ডান্ডাও জীবিত সাপ হয়ে ওঠে, ছোবল দেয়৷ তাই কিছু ভালো ভালো জিনিস যেমন চেতনা, মুক্তবুদ্ধি এগুলোর মালিকানা নিয়ে নিতে হয়৷ আয়োজন করতে হয় কিছু আনুষ্ঠানিকতার, ডান্ডা হাতে বা উর্দি পরে সেখানে ক্রমাগত বলা হয় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা আছে তোমাদের, তবে প্রকাশ শর্তসাপেক্ষ৷ কিছু ডান্ডা বা উর্দিহীন মানুষ এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো একটি তকমা, এমনকি বড় উঠানে এক কাপ চা হাতে শিখে যান উন্নয়নের বীজমন্ত্র৷ সবকিছুতেই তারা উন্নয়ন দেখেন আর আবিষ্কার করেন, একজন ওই যে একজনকেই দেখা যায়, তাকে ছাড়া উন্নয়ন হবে না, দেশ যাবে রসাতলে৷

এই কোরাস আর এই অর্কেস্ট্রার মধ্যেই আমাদের নতুন বছর আসে৷ আমাদের যাদের ভালো চাকরি আছে, তারা ঘরে থেকে বোনাস নেই, মুক্তহস্তে ব্যায়াম করে নতুন কাপড় পরি, দূরের বন্ধুর বাবা করোনায় আক্রান্ত এরকম একটি মাইক্রো আর সারা দেশে বা দুনিয়ায় কতজন মারা গেল, এরকম একটু ম্যক্রো স্ট্যাটাস দেই, রিক্সাওয়ালা কেন রাস্তায় বের হয়, চাওয়ালা কেন দোকান খুলে, বস্তিবাসী কেন ঘরে থাকে না বা লকডাউন হলে কেন গ্রামে চলে যায়- এইসব ভেবে প্রবল মাথা নাড়ি আর ভিডিওকলে ভাবি কবে যে দেশের মানুষ একটু ভাবতে শিখবে!

নতুন বছর নিয়ে আমার প্রত্যাশা নেই এরকম বলা ঠিক হবে না৷ আছে একটাই প্রত্যাশা আমিসহ সবার কাছে৷ আমরা সবাই যেন নিজের কাজটা ভালো করে করি, ভুল হলে স্বীকার করি৷ শুধু প্রিয় বা জনপ্রিয় থাকতে সীমিত পরিসরে মিথ্যা বলার অভ্যাস ছাড়ি আর সবকিছু সামনে থেকে মোকাবিলা করি, পেছন থেকে বা আঁড়ি পেতে নয়৷ শুভ নববর্ষ৷

খালেদ মুহিউদ্দীন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক৷ ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান।
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ