ভারতের পশ্চিম ঘাট পর্বতমালায় নতুন ১৪ প্রজাতির নাচুনে ব্যাঙের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ তবে জলবায়ুর পরিবর্তন আর মানুষের আগ্রাসনে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
বর্ষার শুরুতে পাহাড়ে ঢল নামলেই শুরু হয় ব্যাঙের প্রজনন মৌসুম৷ কিন্তু পুরুষ ব্যাঙের প্রেমের ডাক জলের কলধ্বনিতে চাপা পড়ে যায় বলে এসব প্রজাতির সদস্যরা সঙ্গিনীদের নজর কাড়তে বিশেষ ভঙ্গিতে লম্ফঝম্প করে৷ এ কারণেই বিজ্ঞানীরা আদর করে এদের নাম দিয়েছেন নাচুনে ব্যাঙ বা ড্যান্সিং ফ্রগ৷
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যভামা দাশ বিজু জানান, এসব নাচুনে ব্যাঙের আবাসস্থল গত ১২ বছরে অনেকটাই শুকিয়ে গেছে৷ ফলে তাদের সংখ্যাও দ্রুত কমে আসছে৷
‘‘বিশ্বকে নতুন এসব প্রজাতির খবর জানাতে পেরে আমাদের যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি খুব কষ্ট হচ্ছে, কারণ এসব ব্যাঙকে রক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই৷''
ব্যাঙও এখন বিলুপ্তির হুমকির মুখে
ব্যাঙ ডাকলে একসময় মানুষ বুঝে নিতো বৃষ্টি হবে৷ গ্রামে তো বটেই, শহরেও ছিল ব্যাঙের ছড়াছড়ি৷ সেই দিন আর নেই৷ অনেক ব্যাঙ এখন কমতে কমতে বিলুপ্ত৷ আসুন, দেখে নিই টিকে থাকা ব্যাঙরাজ্যের বর্ণময়তা৷
ছবি: picture-alliance / dpa
ছিল কাতারে কাতার, এখন বিপদ অপার
লাল-চোখ তাদের৷ নাম ডুলেমানোহিলা৷ এ ধরণের ব্যাঙ এখন উভচর (অ্যাম্ফিবিয়ান) প্রাণীদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত৷ নিশাচর এই প্রাণীদের এক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেতো কোস্টারিকা এবং পানামায়৷ এখন থাকার জায়গা কমছে, ছত্রাকজনিত বিশেষ ধরণের ভয়াবহ রোগও হানা দিচ্ছে৷ ফলে লাল-চোখা ব্যাঙেরাও এখন বিলুপ্তির পথে৷সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১৬৫টি প্রজাতির ব্যাঙ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Andreas Hertz
মরছে কেন?
কাইট্রিড এক ধরণের ছত্রাক৷ তাদের কারণে ব্যাঙদের যে রোগ হয় সেই রোগের নাম কাইট্রিডিওমাইকোসিস৷ ব্যাঙ কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসে তাদের গায়ের চামড়া ব্যবহার করে৷ কাইট্রিডিওমাইকোসিস হানা দেয় সেই চামড়ায়৷ পরিণাম- অবধারিত মৃত্যু৷ এমন রোগের কারণও কিন্তু ব্যাঙ৷ আফ্রিকার এক ধরণের ব্যাঙের দেহে এই ছত্রাক আবার নিরাপদে বাস করে৷ ১৯৫০ সালের দিকে মানুষের প্রেগন্যান্সি টেস্টে ব্যবহার করা হতো এই ছত্রাক৷
ছবি: Andreas Hertz
অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে চলা
পানামার এই ব্যাঙটির মতো অনেক ব্যাঙ আছে যারা রেইনফরেস্টে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে একটু বেশি নজর কাড়ে৷ বেশিদিন হয়তো এ অবস্থা থাকবেনা৷ মানুষ গাছ কেটে কেটে বন উজাড় করে দিচ্ছে৷ গাছ না থাকলে ব্যাঙগুলো কোথায় থাকবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং গাছে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারও ব্যাঙের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে৷
ছবি: Andreas Hertz
‘পরিবেশবিদ’ ব্যাঙ
ব্যাঙওপরিবেশবিদ৷ কথাটা মজা করে বললেও, ভেতরে বড় একটা সত্যি লুকিয়ে আছে৷ বিশ্বের অন্য সব প্রাণীর তুলনায় পরিবেশ-প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাঙ অনেক বেশি স্পর্শকাতর৷ পরিবেশের অনেক পরিবর্তন অনেক আগে টের পায় তারা৷ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর আগেভাগে পেয়ে ডেকে ডেকে সবাইকে জানিয়ে দেয়৷ তাই তো ব্যাঙের আরেক নাম, ‘কয়লাখনির খুদে গায়কপাখি’ (ক্যানারিজ ইন দ্য কোলমাইন)৷
ছবি: picture-alliance / dpa
মানুষের বন্ধু
ধেড়ে ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, গিরগিটিসদৃশ ব্যাঙ, গোলাপি ব্যাঙ- কত রকমের ব্যাঙ যে আছে বলে শেষ করা মুশকিল৷ প্রকৃতির খাদ্যপ্রবাহে ভূমিকা রাখে প্রত্যেকে৷ ব্যাঙ পোকামাকড় খায়, ব্যাঙকে খায় সাপ, পাখি, এমনকি মানুষও৷ মানুষ কি শুধু খায়? কিছু ব্যাঙের শরীরে এমন কেমিক্যাল রয়েছে যা কিনা মানুষের অনেক জটিল রোগ সারাতে সহায়তা করে৷ ছবির এই ব্যাঙের দেহে তো এমন ধরণের বিষ রয়েছে যা মানুষ বহুবছর তিরের ফলায় ব্যবহার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্যাঙ দেয় রং
অনেক ব্যাঙ বিলুপ্ত হচ্ছে, পাশাপাশি নতুন কিছু খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে৷ গতবছর জার্মানভিত্তিক প্রাণীবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস হেয়ার্টস পশ্চিম পানামায় খুঁজে পেয়েছিলেন ছবির এই ব্যাঙটিকে৷ অদ্ভুত ধরণের প্রাণী৷ গায়ের রং হলুদ, ধরলে আপনার হাতও হলুদ হয়ে যাবে!
ছবি: picture-alliance/dpa
‘অ্যাম্ফিবিয়ান আর্ক’
উভচর এবং সরিসৃপ প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানীদের বলা হয় ‘হারপেটোলজিস্ট’৷ পিএইচডির ছাত্র আন্দ্রেয়াস হেয়ার্টসও একজন হারপেটোলজিস্ট৷ ‘অ্যাম্ফিবিয়ান আর্ক’ নামের এক প্রকল্পের অধীনে কাজ করছেন ল্যাটিন অ্যামেরিকা অঞ্চলের উভচর এবং সরিসৃপ নিয়ে৷ তাঁদের কাজ হলো, কাইট্রিডে আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যাঙকে বন থেকে তুলে এনে বাঁচিয়ে রাখা৷
ছবি: Sebastian Lotzkat
পুনরাবিষ্কার
ছয় দশক আগে মনে হয়েছিল চোখ ধাঁধানো রঙে রাঙানো এই ব্যাঙগুলো বুঝি চিরতরে হারিয়ে যাবে৷ হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়৷ ২০১১ সালে ইসরায়েলের এক রাস্তায় দেখা গেল এমন একটা ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে৷ সযত্নে ধরে আনা হলো৷ সেই থেকে তাদের খোঁজার চেষ্টা আরো প্রবল হয়েছে৷ পাওয়াও গেছে বেশ কিছু৷ এরা কিন্তু আকার-আকৃতিতে একটুও বদলায় না৷ তাই এদের নাম দেয়া হয়েছে, ‘জীবন্ত ফসিল’৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Mickey Samuni-Blank
ফুসফুসহীন উভচর
এই ব্যাঙগুলোর ফুসফুস বলতে কিছু নেই৷ ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও এলাকার রেইনফরেস্টের খরস্রোতা ঝরনায় এদের বাস৷ পরিবেশ দূষণের কারণে এই ব্যাঙগুলোও এখন বিলুপ্তির পথে৷
ছবি: picture-alliance / dpa
9 ছবি1 | 9
বিজু ও তাঁর সহকর্মীরা যেসব নতুন প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন, সম্প্রতি সেগুলোর বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সিলন'এ৷ সব মিলিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন ২৪ প্রজাতির নাচুনে ব্যাঙ পাওয়া যায় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা৷
ভারতীয় বিজ্ঞানীরা জানান, এসব ব্যাঙ প্রজাতির পুরুষ সদস্যরাই কেবল নাচে৷ ক্ষুদে শরীরের দুই পাশে পা ছড়িয়ে দিয়ে তারা জোরে জোরে চাপড় দিতে থাকে৷ দেহের আকার যতো বড় হয়, নাচও হয় ততো দর্শনীয়৷
এসব প্রজাতিতে ছেলে ও মেয়ে ব্যাঙের সংখ্যার অনুপাত ১০০:১৷ ফলে প্রজনন ঋতুতে সঙ্গী জোগাড় করতে পুরুষ ব্যাঙকে যথেষ্ট কায়দা কসরত করতে হয়৷ প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরে রাখতে লম্বা লম্বা পাগুলো তারা ব্যবহার করে৷
বিজু জানান, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু এলাকাতেও নাচুনে ব্যাঙ দেখা যায়৷ তবে মিক্রিজালিদাই পরিবারভুক্ত ভারতীয় ব্যাঙগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আলাদা হয়েছে আনুমানিক সাড়ে ৮ কোটি বছর আগে৷
‘‘ক্ষুদে এই ব্যাঙ প্রজাতির অবস্থা এতোটাই নাজুক যে পরিবেশের সামান্য পরিবর্তন ঘটলেই এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে,'' বলেন তিনি৷
ভারতে যত ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেখা মেলে, তার অর্ধেকই পশ্চিম ঘাটের এই পার্বত্য এলাকায় পাওয়া যায়৷ কিন্তু লোহা ও বক্সাইটের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি, দূষণ, অপরিকল্পিত চাষাবাদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বহু প্রাণী প্রজাতি তাদের আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্ত হতে বসেছে৷
বিজুর ধারণা, পশ্চিম ঘাটের আদিম প্রকৃতিতে হয়ত আরো অনেক অজানা প্রজাতির ব্যাঙ আছে৷ কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে বিজ্ঞানীরা খোঁজ পাওয়ার আগেই এর মধ্যে অনেক প্রজাতি হয়ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷