১৫ বছর পর মামলার মুখে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’
৩ জানুয়ারি ২০১৭বরুন ভৌমিক নয়ন (৫৮)৷ ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় শুর হওয়া ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের' সময় দৈনিক আল আমীনের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সংসদ বিট কাভার করতেন৷ বাড়ি ঢাকার অদূরে সাভার বাজারে৷ তাঁকে সেনাসদস্যরা প্রথমে ‘ভালো মানুষ' হিসেবে অপারেশন ক্লিনহার্টের পক্ষে জনমত গঠনে কাজে লাগাতেন৷ বিভিন্ন জনসভায় তাকে দিয়ে বক্তৃতা দেয়ানো হতো৷ এক জনসভায় বরুণ ভৌমিক নয়ন বলে ফেলেন, ‘‘আপনারা হার্টঅ্যাটাক বলে মানুষ মেরে ফেলছেন৷ এটা বন্ধ করেন৷ তারপই এই সাংবাদিকের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়৷''
নয়ন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে আটক করা হয়৷ এরপর চোখ বেঁধে নিয়মিতভাবে নির্যাতন করা হয়৷ হাতে অস্ত্র ধরিয়ে ছবি তুলে মামলা দেয়া হয়৷ ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে নিয়মিতভাবে তিন বেলা পিটানো হয়৷ ছয় মাস পর আমি জামিনে মুক্তি পাই৷ আমার পা কেটে ফেলার উপক্রম হয়েছিল৷ ভাগ্যক্রমে তা করতে হয়নি৷ তবে এখনো আমি সেই নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ক্লিনহার্টের সময় আমার বিরুদ্ধে দেয়া অস্ত্র মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে৷ এখন আমি নির্যাতনের বিচার চাই৷ চাই ক্ষতিপূরণ৷''
একইভাবে সাভারের আরেক সাংবাদিক কামরুজ্জামান খানকেও অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নির্যাতন করা হয়৷ ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যৌথবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সারাদেরশে মোট ৫৭ জন নিহত হন৷ নির্যাতনের শিকার হন কয়েক হাজার মানুষ৷
অথচ ২০০৩ সালে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩ পাস করিয়ে যে ন্যয়বিচার চাওয়ার পথও বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার৷ পরে দায়মুক্তির এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না৷ ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট যৌথ অভিযানের দায়মুক্তি অবৈধধ ঘোষণা করেন৷ সোমবার পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলো৷
এই পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে৷ হাইকোর্টে এই মামলার আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা চাইলে সিভিল আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারবেন৷ আবার ক্ষতিপূরণের জন্য প্রত্যেকে আলাদাভাবে হাইকোর্টে রিটও করতে পারবেন৷ ফৌজদারি আইনেও মামলার সুযোগ আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘রুলে হাইকোর্ট ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপুরণের কথা বলেছিলেন৷ তবে আদালত পরে রায়ে সিভিল মামলার বাইরে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে হাইকোর্টে ক্ষতিপুরণের রিট দায়েরের সুযোগ করে দিয়েছে৷ এটা বড় একটি ঘটনা৷ প্রতিকার পাওয়ার বড় একটি রাস্তা৷''
তবে তিনি বলেন, ‘‘ফৌজদারি মামলার সুযোগ থাকলেও ১৫ বছর আগের এই ঘটনা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হতে পারে৷ কারণ ফৌজদারি আইনে মামলা শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ কিন্তু ক্ষতিপূরণের মামলায় ঘটনা প্রমাণ করতে পারলেই হলো৷''
ড. শাহদীন মালিক আরো বলেন, ‘‘মার্কিন সেনাদের ইরাক অভিযানের সময় সেখানকার সাধারণ মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আইন করা হয়৷ শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের সময় এক লাখ নাগরিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন৷ আমাদের দেশে ভবিষ্যতে এ ধরণের অভিযানে ক্ষতিপুরণের জন্য আলাদা আইন করা প্রয়োজন৷''
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘‘জাতীয় সংসদকে সতর্ক থাকতে হবে যেন এ ধরনের সংবিধানের চেতনা-পরিপন্থী আইন আর প্রণীত না হয়৷ ইচ্ছাধীন হত্যাকে দায়মুক্তি দিতে সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না৷''
রায়ে আরো বলা হয়, ‘‘মামলার নথিপত্র ও পেপার ক্লিপিং থেকে এটা স্পষ্ট যে, যৌথবাহিনীর দায়মুক্তি আইন যে সময়ের জন্য করা হয়েছে, ওই সময় দেশে এমন কোনো ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়নি বা দেশে ব্যাপক কোনো নৈরাজ্যও সৃষ্টি হয়নি৷ কিংবা ওই সময় দেশ গৃহযুদ্ধে বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি৷ তাই যৌথবাহিনীর দায়মুক্তি আইন ২০০৩-এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রাণহানির কার্যকে যে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে, সেই দায়মুক্তি সংবিধানের ৩১, ৩২, ৪৬, ৪৭(৩) এবং ৪৭(ক)-এর বিধান মোতাবেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ৷ দায়মুক্তি আইনটি সংবিধানের বিধানা সাপেক্ষে প্রণয়ন হয়নি৷ সুতরাং আইনটি বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো৷''
সাংবাদিক বরুন ভৌমিক নয়ন জানান, ‘‘আমি এরইমধ্যে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ আমি ক্ষতিপূরণ এবং ফৌজদারি দু'দিকেই মামলা করবো৷'' সরকারের একটি সূত্র জানায়, ‘‘সরকার অপারেশন ক্লিন হার্ট নিয়ে মামলাকে নিরুৎসাহিত করবে না৷ কারণ এর ভিকটিমদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী৷'' তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল৷ এবং বিএনপি-জামায়াত জোট ছিল ক্ষমতায়৷