একসময় মাদকাসক্ত ছিলেন ইমতিয়াজ রহমান ইনু৷ এখন তিনি মাদকাসক্তদের আলোর পথে নিয়ে আসার সংগ্রাম করছেন৷ শুধু তাই নয়, শিশুদের জন্য শিক্ষা, দরিদ্রের নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ সহ আরও নানাকাজে নিয়োজিত আছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সিলেটের কুশিঘাট এলাকার বাসিন্দা ইনু জানান, তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন৷ ইভটিজিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ২০০০ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগ আনা হয়৷ সেই হতাশা কাটাতে এক বন্ধুর পরামর্শে প্রথমে সিগারেট, তারপর মাদকের সংস্পর্শে আসেন তিনি৷ বেশ কয়েক বছর কেটে যায় ঐ অবস্থায়৷ পরে একদিন সিলেটের পুরনো রেলস্টেশন এলাকায় মাদক সেবন করে পড়ে থাকা ইনুকে উদ্ধার করেন মেরিস্টোপস সংস্থার দুই কর্মী৷ এরপর তাদের উদ্যোগেই রাজশাহীতে এক পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁর চিকিৎসা হয়৷
ইনু
চিকিৎসায় ভালো হয়ে সিলেটে ফেরার পর ইনুকে এড়িয়ে চলতো তাঁর আশেপাশের মানুষজন৷ তবে ইনু এবার আর হতাশ না হয়ে মাদকাসক্তদের মাদকের ভয়াল থাবা সম্পর্কে সচেতন করার কাজ শুরু করেন৷ শহরের মাদকাসক্তদের আখড়ায় গিয়ে তাদের নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে থাকেন৷ এভাবে এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন বলে সাক্ষাৎকারে জানান ইনু৷ এর মধ্যে ১০ জন এখনও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছে বলে জানান তিনি৷
ইনু বলেন, ‘‘মাদকাসক্ত কেউ সুস্থ হয়ে ফিরে এলে তাকে সঠিক পথে রাখতে তার পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে৷ এছাড়া তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও জরুরি৷ না হলে আবারও একই অবস্থা হবার আশঙ্কা থাকে৷''
ছিলেন মাদকাসক্ত, হয়েছেন আলোর ফেরিওয়ালা
সিলেটের কুশিঘাট এলাকার বাসিন্দা ইমতিয়াজ রহমান ইনু একসময় মাদকাসক্ত ছিলেন৷ এখন তিনি সুস্থ হয়ে মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করছেন৷
ছবি: I.Rahman Inu
যেভাবে মাদকাসক্ত হয়েছিলেন
সিলেটের কুশিঘাট এলাকার বাসিন্দা ইমতিয়াজ রহমান ইনু৷ ইভটিজিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ২০০০ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগ আনা হয়৷ সেই হতাশা কাটাতে এক বন্ধুর পরামর্শে প্রথমে সিগারেট, তারপর মাদকের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি৷ পরে চিকিৎসা নিয়ে মাদকের আসক্তি থেকে মুক্ত হন৷
ছবি: I.Rahman Inu
মাদকাসক্তদের সঙ্গে আলোচনা
চিকিৎসায় ভালো হয়ে সিলেটে ফেরার পর ইনুকে এড়িয়ে চলতো তাঁর আশেপাশের মানুষজন৷ তবে ইনু তাতে হতাশ না হয়ে মাদকাসক্তদের মাদকের ভয়াল থাবা সম্পর্কে সচেতন করার কাজ শুরু করেন৷ ছবিতে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বীন ব্রিজের নীচে মাদকাসক্তদের আলোর পথে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন ইনু৷ এভাবে এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে সুস্থ হতে সহায়তা করেছেন বলে জানান তিনি৷
ছবি: I.Rahman Inu
শিশুদের জন্য স্কুল
মাদকাসক্তি কাটিয়ে ওঠার পরের সময়টাকে ‘বোনাস’ জীবন হিসাবে দেখছেন ইনু৷ এই জীবনে মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে তিনি এখন নিজেকে সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত রেখেছেন৷ মাদকাসক্তদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি স্কুল চালু করেছেন৷ ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিজের টাকা খরচ করে এলাকার শিশুদের শিক্ষা দিয়েছেন৷ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিতে গড়ে তুলেছেন ‘ইনুর ইশকুল’৷
ছবি: I.Rahman Inu
স্কুল পরিদর্শনে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা
২০১৫ সালে ইনুর ইশকুল পরিদর্শনে যান সিলেটের জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী সেলিনা চৌধুরী৷ সেই সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নতির জন্য নিজেকে গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান৷
ছবি: I.Rahman Inu
শিশুদের ইতিহাস শেখানো
ছবির এই জিনিসগুলো ইনু নিজেই কাগজ দিয়ে তৈরি করেছেন৷ এভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের দেশের বিভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারনা দেন৷
ছবি: I.Rahman Inu
নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ
শিশুদের পাশাপাশি এলাকার দরিদ্র নারীদের কথাও ভেবেছেন ইনু৷ তাই তাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিতে দুটি সেলাই মেশিন কিনেছেন৷
ছবি: I.Rahman Inu
পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব
ইনু বলেন, ‘‘মাদকাসক্ত কেউ আসক্তি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলে তাকে সঠিক পথে রাখার জন্য পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে৷ এছাড়া তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও জরুরি৷ না হলে আবারও একই অবস্থা হবার আশঙ্কা থাকে৷’’ ইনু জানালেন, তাঁর মা তাঁকেও ভালো পথে স্থায়ী হতে সহায়তা করেন৷ ‘সুস্থ’ হয়ে ফেরাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে প্রবাসীদের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: I.Rahman Inu
7 ছবি1 | 7
নিজের ক্ষেত্রে তাঁর মা তাঁকে ভালো থাকতে সহায়তা করেছে জানিয়ে ইনু বলেন, ‘‘যে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের ছোট্ট শিশুর মতো আচরণ করতে হবে৷ ছোট্ট শিশুদের যেমন নতুন করে সবকিছু শেখানো হয় (ফিরে আসা) মাদকাসক্তদের সঙ্গেও সেরকম আচরণ করতে হবে৷''
‘বোনাস জীবন'
মাদকাসক্ত জীবন থেকে সুস্থ হয়ে ওঠায় এখনকার জীবনকে ‘বোনাস' হিসাবে দেখছেন ইনু৷ এই জীবনে মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে তিনি এখন নিজেকে সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত রেখেছেন৷ মাদকাসক্তদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি স্কুল চালু করেছেন৷ ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিজের টাকা খরচ করে এলাকার শিশুদের শিক্ষা দিয়েছেন৷ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক টুকরো জমিতে গড়ে তুলেছেন ‘ইনুর ইশকুল'৷ ২০১৪ সাল থেকে সিলেটের একটি অনলাইন পোর্টালের সহায়তায় স্কুলটি পরিচালিত হচ্ছে৷
এছাড়া এলাকার দরিদ্র নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে তাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন ইনু৷ বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মেয়েদের সচেতন করতে মানববন্ধন সহ অন্যান্য উদ্যোগও নিয়ে থাকেন বর্তমানে সেভ দ্য চিলড্রেন এর মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করা ইনু৷
প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান
সাক্ষাৎকারে ইনু মাদকাসক্তদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করতে প্রবাসীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান৷ মাদকের কুফলগুলো আরও বেশি করে প্রচারের মাধ্যমে সকলকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি৷
বন্ধুরা, ইমতিয়াজ রহমান ইনু জীবনের কথা, তাঁর কাজ আপনার কেমন লাগলো? আপনার মতামত আমাদের জানান, লিখুন নীচের ঘরে৷
বিশ্বের অদ্ভুত সব মাদক নিরাময় কেন্দ্র
আমাদের দেশে মাদকাসক্তি এখন বড় ধরনের সমস্যা৷ তবে মাদকাসক্তদের জন্য এখন বেশ কিছু নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে৷ কিন্তু সেগুলো এতটা অদ্ভুত হয়ত নয়৷ বিশ্বের অদ্ভুত কিছু মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
থাইল্যান্ডের পুনর্বাসন কেন্দ্র
থাইল্যান্ডে ফ্রা পুত্থাবাতের কাছে থামক্রাবক মঠ৷ এখানে মাদকাসক্তদের ভিন্ন উপায়ে চিকিৎসা করা হয়৷ আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক উপায়ে মাদকাসক্তদের মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি এনে দেয়ার চেষ্টা করেন মঠের সন্ন্যাসীরা৷
ছবি: N.Asfouri/AFP/Getty Images
বমনের মাধ্যমে শুদ্ধি
এখানে সাধারণত মাদকাসক্তদের ১০দিনের একটি কর্মসূচিতে রাখা হয়৷ তবে এর মধ্যে বহির্বিশ্বের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা গড়ে না উঠলে আরো দীর্ঘ সময় সেখানে থাকতে পারেন তারা৷ ভোর বেলা প্রত্যেককে একটি পানীয় খেতে বাধ্য করা হয়, যার ফলাফল বমি৷ মঠের সন্ন্যাসীদের মতে পানীয়টি খুবই বাজে, কিন্তু কার্যকর৷ এছাড়া মঠ ছাড়ার আগে প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে অঙ্গীকার করতে হয় যে, সে আর কখনো মাদক ছুঁয়ে দেখবে না৷
ছবি: Getty Images/Paula Bronstein
আধ্যাত্মিক চেতনা
পেরুর আয়াহুয়াস্কা নিরাময় কেন্দ্রে প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির চিকিৎসা নিতে যান৷ সেখানকার আদিবাসীদের বিশ্বাস আয়াহুয়াস্কা প্রত্যেকের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি এনে দেয়৷ তবে পশ্চিমা চিকিৎসকদের মতে এ ধরনের চিকিৎসার ফলে ভয়ের স্মৃতি, বমি, প্রচুর ঘাম এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷ তাই বিশ্বের অনেক দেশে এখন আয়াহুয়াস্কা নিষিদ্ধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V.Donev
ধর্মীয় পন্থা
ব্রাজিলের রিও ডি জানেরোর পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি৷ এখানে আধ্যাত্মিক উপায়ে চিকিৎসা করা হয়৷ প্রতিদিন সকালে সব মাদকাসক্ত ব্যক্তি জড় হয়ে ঈশ্বরের বন্দনা করেন৷ প্রত্যেককেই একটি গির্জার পাশে থাকতে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP/ F.Dana
শিকল বেঁধে চিকিৎসা
এই ব্যাক্তির নাম আমানউল্লাহ, যাকে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে জালালাবাদে একটি মাজারে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে৷ এখানে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করা হয়৷ শিকল দিয়ে ৪০ দিন বেঁধে রাখা হয় তাদের৷ খেতে দেয়া হয় একটু রুটি, অল্প পানি আর একটু মরিচের গুড়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
আধ্যাত্মিক সাহায্য
মীর আলী বাবা, যাঁর নামে এই মাজার৷ স্থানীয়দের বিশ্বাস, মাদকাসক্তদের এখানে এভাবে বেধে রাখার ফলে আলী বাবা তাদের এই আসক্তি থেকে বের হতে সাহায্য করেন৷ এই ধারণা কেবল আফগানিস্তানেই নয় বিশ্বের অনেক স্থানে রয়েছে৷ কিছু স্থানে মাদকাসক্তদের শাস্তি দেয়া হয়, এমনকি হত্যা করাও হয়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R.Gul
শ্রমিক শিবির
চীনে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন হয় জেলখানায়৷ কারাদণ্ড হওয়ার পর ঐ ব্যক্তিকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়৷ কোকেইন, হেরোইন বা মারিজুয়ানা নিয়ে কেউ ধরা পড়লেও একই শাস্তি৷ তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, চীন মাদকাসক্তদের ক্লিনিকগুলোকে শ্রমিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে৷ অর্থাৎ তাদের দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Shenglian
মৃত্যু অভিজ্ঞতা
কিরঘিজস্তানে যে পুনর্বাসন পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয় তা ভয়াবহ৷ এটাকে বলা হয় ‘কোমা চিকিৎসা’৷ মাদকাসক্তদের একটি ইনজেকশন দেয়া হয় যার প্রভাবে তারা কয়েক ঘণ্টা কোমা’র মতো অবস্থায় থাকে৷ এরপর যখন তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় বলে বিশ্বাস সেখানকার মানুষের৷ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন৷
ছবি: picture alliance/Robert Harding World Imagery
বিলাসবহুল পন্থা
অনেক তারকারা মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে বিলাসবহুল পথ বেছে নেন৷ সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্ধতিটি হয় অ্যামেরিকার বেটি ফোর্ড ক্লিনিকে৷ এখানে বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ও অভিনেতারা চিকিৎসা করান৷ এই ক্লিনিকে এমন কিছু সুযোগ সুবিধা থাকে যাতে আপনার মনে হবে আপনি একটি বিলাসবহুল হোটেলে আছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A.Rain
সবার চিকিৎসার সুযোগ নেই
বিশ্বের বেশিরভাগ মাদকাসক্তের চিকিৎসার সুবিধা নেই৷ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, সে দেশের মাত্র ১০.৪ শতাংশ মাদকাসক্ত ব্যক্তি চিকিৎসার সুবিধা পান৷ গরীব দেশগুলোতে এ অবস্থা আরো শোচনীয়৷