হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনার মধ্যে দ্রুত অভিযোগ নেয়া, দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা করানো ও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ টেস্ট অন্যতম৷ অবহেলা হলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ ফলে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণ আগের চেয়ে আরো সহজ হবে৷
বিজ্ঞাপন
শুধু ধর্ষণ নয়, সব ধরণের যৌন হয়রানির ব্যাপারেই আদালতের এই নির্দেশনা৷ আর ঘটনার শিকার নারী যে থানায় যাবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ তাঁদের থানা এলাকার ঘটনা নয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না৷
২০১৫ সালের ২১ মে রাতে ঢাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী৷ রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে ওই তরুণী কুড়িল থেকে উত্তরার বাসায় যাওয়ার পথে একটি সিএনজি স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ তখন একটি মাইক্রোবাস থেকে দুই যুবক নেমে অস্ত্র দেখিয়ে মুখ চেপে ধরে তাঁকে গাড়িতে তুলে নেয়৷ ওই গাড়িতেই পাঁচজন তাঁকে ধর্ষণ করে৷ রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে দৃর্বৃত্তরা উত্তরার একটি সড়কে ফেলে দিয়ে মাইক্রোবাসটি নিয়ে পালিয়ে যায়৷
রাতেই ওই তরুণী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে তুরাগ থানায় মামলা করতে যান৷ কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ মামলা না নিয়ে তাঁদের ভোররাত ৪টার দিকে ফিরিয়ে দেয়৷ এরপর ভোর ৫টার দিকে তাঁরা যান গুলশান থানায়৷ সেখানেও তাঁদের এলাকার ঘটনা না বলে মামলা নেয়া হয়নি৷ সবশেষ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে৷ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাঁদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নেয় ভাটারা থানা৷ ওই তরুণীকে চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয় আরো একদিন পর৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
এই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ব্লাস্টসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন বাদী হয়ে হাইকোর্টে রিট করে৷ রিটের শুনানি করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ ওই বছরের ২৫ মে রুল জারি করে৷ ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় আদালত৷ আদালত তখন কিছু নির্দেশনাও দেয়৷ রবিবার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে ধর্ষণের বিষয়ে ১৮ দফা নির্দেশনাসহ পরামর্শ দেন আদালত৷
আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন৷ এক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক-বা-না-হোক, সেটা মুখ্য নয়৷ অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যেন এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়৷
সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান তৈরি করতে হবে৷
রায়ে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে৷ একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে৷
এছাড়া যেকোনও রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনও ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়েছে৷ পাশাপাশি দ্রুত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নীচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে৷ অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্খী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
11 ছবি1 | 11
সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী-সমাজকর্মীদের একটি তালিকা রাখার কথা বলা হয়েছে৷ অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দেয়া অধিকার সম্পর্কে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে৷
আদালতের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ডিউটি অফিসার ‘ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার'কে জানাবেন৷ ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার কোনও নারী বা মেয়ে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম হলে, তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে৷ লিখিত তথ্য গ্রহণের পর কোনও ধরনের বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন৷ ভুক্তভোগীর দ্রুত সারিয়ে তুলতে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে৷
নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে ‘১০৯’ নাম্বারে ফোন করে যেন প্রতিকার পেতে পারে, সে বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ওয়েব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷
ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ আদালত বলেছে, এই ১৮ দফা নির্দেশনার ভিত্তিতে সুনির্দষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে৷ সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে৷
হাইকোর্টের এই সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা ও আইন তৈরি করতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে৷
যে থানাতেই ভিকটিম হাজির হবেন সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে: সুলতানা কামাল
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী অভিযোগ করতে গিয়ে এবং ঘটনা প্রমাণ করতে নানা হয়রানির শিকার হন৷ আর ডাক্তারি পরীক্ষা দেরি হলে ধর্ষণের অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷ তার প্রতিকার পেতেই আমরা ওই রিটটি করেছিলাম৷ আদালত যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে ভুক্তভোগীর হয়রানি কমবে এবং ঘটনা প্রমাণ আগের চেয়ে সহজ হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশনা অনুয়ায়ী, থানা মামলা নিতে আর দেরি করার সুযোগ পাবে না, কারণ যে থানায়ই ভিকটিম হাজির হবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ আর ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে মামলা দেয়ার পরপরই৷ এরফলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাবে৷ ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক এবং তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করার যে নির্দেশ হাইকোর্ট দিয়েছেন, তা-ও অনেক সহায়ক হবে ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য৷ ডিএনএ টেষ্টের মাধ্যমে ধর্ষককে চিহ্নিত করা সহজ হবে, কারণ, ঘটনাস্থলে ধর্ষকের ডিএনএ আলামত থাকে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আদালতের এই নির্দেশনা কার্যকর করা এবং দ্রুত আইন ও বিধান তৈরি করা জরুরি৷ এই নির্দেশনা পালন না করলে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটি ভালো দিক৷ এর ফলে পুলিশ কর্মকর্তারা এটা মানতে সক্রিয় হবেন৷’’
হাইকোর্ট ধর্ষণ নিয়ে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সেটা আইন, এবং তা মানা বাধ্যতামূলক: মিতি সানজানা
আর ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগেই কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত৷ আর টু-ফিঙ্গার টেস্টও নিষিদ্ধ করেছেন৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা বাস্তবায়ন হতে দেখি না৷ আমাদের সবাইকে প্রথম যেটা বুঝতে হবে তা হলো, হাইকোর্ট ধর্ষণ নিয়ে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, সেটা আইন৷ এই আইন মানা বাধ্যতামূলক৷ আইন না হওয়া পর্যন্ত এটাই আইন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘হাইকোর্টের এই ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে৷ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ সুতরাং সরকারকে এটা কার্যকর করতে হবে৷ তবে মিডিয়াকেও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে৷ আদালতের রায়ে সেই নির্দেশনাও আছে৷ ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হাইকোর্টের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে হবে৷ নিতে হবে একটি সমন্বিত উদ্যোগ৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...