1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্ষণ বিষয়ে ১৮ দফা নির্দেশনা হয়রানি কমাবে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৮ মে ২০১৮

হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনার মধ্যে দ্রুত অভিযোগ নেয়া, দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা করানো ও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ টেস্ট অন্যতম৷ অবহেলা হলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ ফলে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণ আগের চেয়ে আরো সহজ হবে৷

ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor

শুধু ধর্ষণ নয়, সব ধরণের যৌন হয়রানির ব্যাপারেই আদালতের এই নির্দেশনা৷ আর ঘটনার শিকার নারী যে থানায় যাবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ তাঁদের থানা এলাকার ঘটনা নয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না৷

২০১৫ সালের ২১ মে রাতে ঢাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী৷ রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে ওই তরুণী কুড়িল থেকে উত্তরার বাসায় যাওয়ার পথে একটি সিএনজি স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ তখন একটি মাইক্রোবাস থেকে দুই যুবক নেমে অস্ত্র দেখিয়ে মুখ চেপে ধরে তাঁকে গাড়িতে তুলে নেয়৷ ওই গাড়িতেই পাঁচজন তাঁকে ধর্ষণ করে৷ রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে দৃর্বৃত্তরা উত্তরার একটি সড়কে ফেলে দিয়ে মাইক্রোবাসটি নিয়ে পালিয়ে যায়৷

রাতেই ওই তরুণী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে তুরাগ থানায় মামলা করতে যান৷ কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ মামলা না নিয়ে তাঁদের ভোররাত ৪টার দিকে ফিরিয়ে দেয়৷ এরপর ভোর ৫টার দিকে তাঁরা যান গুলশান থানায়৷ সেখানেও তাঁদের এলাকার ঘটনা না বলে মামলা নেয়া হয়নি৷ সবশেষ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে৷ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাঁদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নেয় ভাটারা থানা৷ ওই তরুণীকে চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য  হাসপাতালে নেয়া হয় আরো একদিন পর৷

এই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ব্লাস্টসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন বাদী হয়ে হাইকোর্টে রিট করে৷ রিটের শুনানি করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ ওই বছরের ২৫ মে রুল  জারি করে৷ ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় আদালত৷ আদালত তখন কিছু নির্দেশনাও দেয়৷ রবিবার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে ধর্ষণের বিষয়ে ১৮ দফা নির্দেশনাসহ পরামর্শ দেন আদালত৷

আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন৷ এক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক-বা-না-হোক, সেটা মুখ্য নয়৷ অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যেন এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়৷

সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান তৈরি করতে হবে৷

রায়ে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে৷ একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে৷

এছাড়া যেকোনও রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনও ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়েছে৷ পাশাপাশি দ্রুত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷

প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নীচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে৷ অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্খী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন৷

সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী-সমাজকর্মীদের একটি তালিকা রাখার কথা বলা হয়েছে৷ অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দেয়া অধিকার সম্পর্কে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে৷

আদালতের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ডিউটি অফিসার ‘ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার'কে জানাবেন৷ ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার কোনও নারী বা মেয়ে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম হলে, তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে৷ লিখিত তথ্য গ্রহণের পর কোনও ধরনের বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন৷ ভুক্তভোগীর দ্রুত সারিয়ে তুলতে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে৷

নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে ‘১০৯’ নাম্বারে ফোন করে যেন প্রতিকার পেতে পারে, সে বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ওয়েব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷

ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ আদালত বলেছে, এই ১৮ দফা নির্দেশনার ভিত্তিতে সুনির্দষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে৷ সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে৷

হাইকোর্টের এই  সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা ও আইন তৈরি করতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে৷

যে থানাতেই ভিকটিম হাজির হবেন সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে: সুলতানা কামাল

This browser does not support the audio element.

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী অভিযোগ করতে গিয়ে এবং ঘটনা প্রমাণ করতে নানা হয়রানির শিকার হন৷ আর ডাক্তারি পরীক্ষা দেরি হলে ধর্ষণের অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷ তার প্রতিকার পেতেই আমরা ওই রিটটি করেছিলাম৷ আদালত যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে ভুক্তভোগীর হয়রানি কমবে এবং ঘটনা প্রমাণ আগের চেয়ে সহজ হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশনা অনুয়ায়ী, থানা মামলা নিতে আর দেরি করার সুযোগ পাবে না, কারণ যে থানায়ই ভিকটিম হাজির হবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ আর ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে মামলা দেয়ার পরপরই৷ এরফলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাবে৷ ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক এবং তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করার যে নির্দেশ হাইকোর্ট দিয়েছেন, তা-ও অনেক সহায়ক হবে ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য৷ ডিএনএ টেষ্টের মাধ্যমে ধর্ষককে চিহ্নিত করা সহজ হবে, কারণ, ঘটনাস্থলে ধর্ষকের ডিএনএ আলামত থাকে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আদালতের এই নির্দেশনা কার্যকর করা এবং দ্রুত আইন ও বিধান তৈরি করা জরুরি৷ এই নির্দেশনা পালন না করলে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটি ভালো দিক৷ এর ফলে পুলিশ কর্মকর্তারা এটা মানতে সক্রিয় হবেন৷’’

হাইকোর্ট ধর্ষণ নিয়ে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সেটা আইন, এবং তা মানা বাধ্যতামূলক: মিতি সানজানা

This browser does not support the audio element.

আর ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগেই কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত৷ আর টু-ফিঙ্গার টেস্টও নিষিদ্ধ করেছেন৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা বাস্তবায়ন হতে দেখি না৷ আমাদের সবাইকে প্রথম যেটা বুঝতে হবে তা হলো, হাইকোর্ট  ধর্ষণ নিয়ে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, সেটা আইন৷ এই আইন মানা বাধ্যতামূলক৷ আইন না হওয়া পর্যন্ত এটাই আইন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘হাইকোর্টের এই ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে৷ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ সুতরাং সরকারকে এটা কার্যকর করতে হবে৷ তবে মিডিয়াকেও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে৷ আদালতের রায়ে সেই নির্দেশনাও আছে৷ ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হাইকোর্টের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে হবে৷ নিতে হবে একটি সমন্বিত উদ্যোগ৷’’

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ