বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি
হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১ এপ্রিল ২০১৫
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর কোনো ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়নি৷ তবে কারাগারে এক হাজারেরও বেশি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন৷ এদিকে, বিশ্বের যে ৫২টি দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, শাস্তি হিসেবে বিশ্বে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ২,৪৬৬ - যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা হিসেবে ২৮ ভাগ বেশি৷ মিশর ও নাইজেরিয়ায় গণবিচারে কয়েকশ মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় এই সংখ্যা বেড়েছে৷
তবে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সংখ্যা কমেছে৷ ২০১৩ সালে বিশ্বের ২২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে এক বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরিমাণ কমেছে ২২ ভাগ৷ ২০১৪ সালে ৬০৭টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷
অ্যামনেস্টি বলছে চীনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কারণে সেখানকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হিসাব পাওয়া যায়না৷ চীন এই হিসাব প্রকাশ করে না৷
একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি বৃহস্পতিবার রাতে কার্যকর করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো৷ মোল্লার ফাঁসি নিয়ে তৈরি আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
অবশেষে ফাঁসি
৪৮ ঘণ্টা ধরে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ এর আগে মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে বিচারকের নির্দেশে তা স্থগিত হয়৷ মোল্লাকে এভাবে ফাঁসি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জার্মানি সহ অন্যান্যরা৷
ছবি: picture-alliance/AA
শেষ দেখা
বৃহস্পতিবার ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছুক্ষণ আগে কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরিবারের সদস্যরা৷ এসময় জেলগেটে কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বলেন, ‘‘ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই আমার পিতাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Reuters
গ্রেপ্তার, দম্ভোক্তি
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০০৮ সালে ঢাকার একটি থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা৷ পরবর্তীতে কারাগারে দাঁড়িয়ে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘বাংলাদেশ হয়েছে বলে অনেকের মাতব্বরি বেড়ে গেছে৷’’
ছবি: Reuters
যত অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট ৬টি অপরাধ বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এগুলো হলো পল্লবি এলাকার গণহত্যা, কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালিব হত্যা, কেরানীগঞ্জের ভাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড, আলুব্দি গণহত্যা এবং মিরপুরের হযরত আলি পরিবারে গণহত্যা৷ এর সঙ্গে লুটতরাজ, ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগও আছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Archiv Rowshan Jahan Shathi
প্রথমে যাবজ্জীবন, পরে মৃত্যুদণ্ড
ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণিত হয়৷ এর প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে৷ সেসময় কাদের মোল্লা আদালত থেকে বের হওয়ার সময় ‘বিজয় চিহ্ন’ দেখান৷ এতে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ পরবর্তীতে আপিলের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
দাফন সম্পন্ন
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদুপরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।’’
ছবি: Mustafiz Mamun
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সৃষ্টি হওয়া শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আবারো ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ৷ মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে৷
ছবি: Reuters
‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো’’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো৷ ৪২ বছর পরে হলেও একজন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হলো৷’’ তিনি আশা করেন, সব যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডই কার্যকর হবে৷
ছবি: privat
জার্মানির প্রতিক্রিয়া
এর আগে, বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
চীনের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পাঁচটি শীর্ষ দেশ হলো ইরান, সৌদি আরব, ইরাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সুদান৷ এইসব দেশে ২০১৪ সালে যথাক্রমে ইরানে ২৮৯, সৌদি আরবে ৯০, ইরাকে ৬১, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ ও সুদানে ২৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে, যা আশঙ্কাজনক বলে মনে করে অ্যামনেস্টি৷ এই দেশগুলোর মধ্যে চীন, ইরান, ইরাক ও পাকিস্তান অন্যতম৷ পাকিস্তানে গতবছর সাতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৯৮টি দেশ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে৷ এছাড়া মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ নেই এমন দেশের সংখ্যা ৪২টি৷ তাই বিশ্বের ১৪০টি দেশে এখন আর মৃত্যুদণ্ড নেই৷ সর্বশেষ মাদাগাস্কার মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করেছে৷
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা ৫২টি দেশের একটি৷ বাংলাদেশের কারাগারে এখন ১,২৪২ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন বলে জানা যায়৷
২০১৩ সালের পর বাংলাদেশে কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন৷ তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
তবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১৪২ জনেরও বেশি আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ আর চলতি বছরে আরো অন্তত ২৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে বলে জানা গেছে৷
বিভিন্ন দেশে যেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য একেক দেশ একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমন কয়েকটি উপায়ের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইনজেকশন
অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সোডিয়াম পেন্টোনাল, সম্পূর্ণ অক্ষম করার জন্য প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড আর হৃদযন্ত্র থামিয়ে দেয়ার জন্য পটাশিয়াম ক্লোরাইড নামের তিনটি রাসায়নিক উপাদান ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনামে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: BilderBox
গুলি
ইন্দোনেশিয়া, চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ এরপর সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একের পর এক গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে
অভিযুক্তকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে তার মাথা ও পায়ের মাধ্যমে শরীরে ৫০০ থেকে ২,০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ প্রতিবার ৩০ সেকেন্ড করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ এই পদ্ধতিটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাঁসি
বাংলাদেশ সহ আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, ইরাক, জাপান, মালয়েশিয়া ও কুয়েতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
শিরশ্ছেদ
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিরশ্ছেদ বিষয়টি রয়েছে৷ তবে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবে এই পদ্ধতিটি চালু রয়েছে৷ সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে শিরশ্ছেদ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
অন্যান্য উপায়
পাথর ছুড়ে মারা, গ্যাস চেম্বারে ফেলে দেয়া, অনেক উঁচু থেকে অভিযুক্তকে নীচে ফেলে দেয়ার মাধ্যমেও কোথাও কোথাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এপর্যন্ত ৪২৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে এক বছরে সর্বোচ্চ ২৪৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা
বাংলাদেশে নরহত্যাসহ আরো কিছু গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী৷ কারণ আমরা মনে করি কোনো গুরুতর অপরাধের বিচারই মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে সম্ভব নয়৷ এতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়৷ প্রয়োজনে অপরাধীকে ৫০০ বছর কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে, তবে মৃত্যুদণ্ড নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘মৃত্যুদণ্ড যে কোনো অপরাধের শাস্তি হতে পারে না তা আজ সারা বিশ্বে প্রমাণিত হচ্ছে৷ তাই বিশ্বে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রহিতকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে৷ আমি আশা করি বাংলাদেশেও একদিন মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকবে না৷''