এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার স্থগিত রাখা হচ্ছে, তবে তা পরের বছর প্রদান করা হবে, বলে জানিয়েছে সুইডিশ অ্যাকাডেমি৷ যৌন হয়রানি সংক্রান্ত ‘সংকটের' কারণেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
গত নভেম্বর মাসে একটি সুইডিশ দৈনিক ১৮ জন মহিলার বিবৃতি প্রকাশ করে, যারা দাবি করেছেন যে, সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্য কাটারিনা ফ্রস্টেনসনের স্বামী জাঁ-ক্লোদ আর্নো তাদের ধর্ষণ করেছেন, অথবা তাদের উপর যৌন হামলা চালিয়েছেন কিংবা অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানি করেছেন৷ ফ্রস্টেনসন সুইডেনের সাংস্কৃতিক মহলে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি৷ তিনি ও তাঁর ফরাসি স্বামী আর্নো যে সাংস্কৃতিক চক্রটি চালিয়ে থাকেন, তা অ্যাকাডেমির কাছ থেকে অর্থসাহায্য পায়৷
নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিতর্কিত বিজয়ীরা
ইয়াসির আরাফাত থেকে জাতিসংঘ– কেন তারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন? প্রায় প্রতি বছর অসলোতে ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন ওঠে৷ এমন কয়েকজন শান্তিতে নোবেলজয়ীকে নিয়েই এই ছবিঘর..
ছবি: Getty Images
দীর্ঘদিনের আলোচনা
১৯০১ সালে যখন প্রথম সুইজারল্যান্ডের হেনরি ডুনান্ট (বামে) এবং ফ্রান্সের ফ্রেডেরিক প্যাসিকে (ডান দিকে) নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়, তখনই এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল নোবেল কমিশন৷ ডুনান্ট আন্তর্জাতিক রেড ক্রস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্যাসির সঙ্গে একযোগে জেনেভা কনভেনশনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ নোবেল কমিশনের আশঙ্কা ছিল, যুদ্ধকে মানবিক করার কথা বলে জেনেভা কনভেনশন হয়ত যুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়িয়ে দেবে৷
ছবি: public domain
যুদ্ধবাজ এবং শান্তিকামী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টকে কখনোই খুব শান্তিকামী হিসেবে দেখা যায়নি৷ তিনি স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহ্বান করেছিলেন৷ এরপর উপনিবেশবাদ থেকে কিউবাবাসীদের মুক্ত হতে সাহায্য করেন৷ তবে মার্কিন সেনাবাহিনী গিয়েই প্রথমে নিশ্চিত করেন যে, ওই ভূখণ্ডটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷তবে রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় শান্তির উদ্যোগের জন্য রুজভেল্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান৷
ছবি: Getty Images
বর্ণবাদী শান্তিকামী
‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং লীগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা’য় অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ২8 তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়৷ তবে তিনি সব সময়ই সাদা চামড়ার মানুষদেরই সেরা মনে করতেন৷ সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সাদাদের স্বর্গরাজ্য’ বানাতে চেয়েছিল ‘কু ক্লুক্স ক্ল্যান’ নামের যে প্রতিষ্ঠানটি, তাদের পক্ষে ছিলেন উইলসন৷
ছবি: Getty Images
শান্তি ছাড়াই শান্তি পুরস্কার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামের পলিটব্যুরোর সদস্য লি ডুক থো ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন৷যুদ্ধ বন্ধের জন্যই এ চুক্তি করা হলেও ডুক থো পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান, কেননা চুক্তি হলেও যুদ্ধ তখনো থামেনি৷চুক্তি সম্পাদনের দু’ বছর পরেও ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়াতে সংঘাত চলেছে৷
ছবি: picture-alliance
অভ্যুত্থানকারীর ভাগ্যেও শান্তি পুরস্কার
মিশর-ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় একমত হয়ে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত (বামে) ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন (ডানে)৷ ১৯৭৮ সালে এ কারণে শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় তাঁদের৷ সাদাতের এই পুরস্কার সে সময় বেশ আলোড়ন তোলে৷ কারণ, ১৯৫২ সালে বাদশাহ ফারুককে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন আনোয়ার সাদাত৷
ছবি: AFP/Getty Images
শান্তিরক্ষা এবং নোংরামি
‘দ্য ব্লু হেলমেট’ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী৷ ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তাঁদের৷ তবে নোবেল জয়ের পরই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় নারী ও শিশুদের যৌন নির্যাতন ও তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে৷ রুয়ান্ডায় গণহত্যা এবং স্রেব্রেনিকায় ব্যাপক হত্যাকান্ডের সময় নির্লিপ্ত থাকার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে৷
ছবি: Getty Images/A.G.Farran
দুই মুখো মানুষ
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এফ.ডব্লিউ ডি ক্লার্ক এক সময় সে দেশে সরাসরি বর্ণবাদের পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ পরে বর্ণবিদ্বেষ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷নেলসন ম্যান্ডেলাসহ ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনেক নেতাকে মুক্তি দেন তিনি৷ তা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে ম্যান্ডেলার সঙ্গে তাঁকেও শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকে৷
ছবি: Getty Images/R.Bosch
‘সন্ত্রাসী’ পেলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার!
১৯৯৪ সালের পুরস্কার নিয়ে ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায়৷ সে বছর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রচেষ্টার জন্য ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেসকে যৌথভাবে শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়৷ আরাফাতকে ‘অযোগ্য বিজয়ী’ আখ্যায়িত করে এর প্রতিবাদে নোবেল কমিটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নরওয়ের এক রাজনীতিবিদ৷
ছবি: Getty Images
জাতিসংঘও পেয়েছে শান্তি পুরস্কার
‘আরো ভালো এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব’ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য ২০০১ সালে জাতিসংঘ ও এর মহাসচিব কোফি আনানকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয৷ তবে অনেকগুলো চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে তাদের ব্যাপক সমালোচনা তাতে থামেনি৷
ছবি: Reuters
বারাক ওবামার আগাম জয়ের মালা
‘আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং জনগণের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারে অসাধারণ ভূমিকার জন্য’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার নয় মাসের মাথায় পুরস্কার পান ওবামা৷ সমালোচকরা মনে করেন, বড্ড তড়িঘড়িই এসেছিল পুরস্কারটি৷ পরে তিনি আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সামরিক হস্তক্ষেপ অনুমোদন করেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী হওয়ায় ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়৷
ছবি: Reuters/C. Barria
যুদ্ধাপরাধে সহায়তাকারী থেকে নারী অধিকার কর্মী
হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও নির্যাতনের হাজার হাজার মামলাসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলর৷ তার সরকারের অর্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হওয়া এলেন জনসন সিরলেফের বিরুদ্ধেও টেইলরকে ওইসব কর্মকাণ্ডের সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে৷২০১১ সালে ‘নারীদের নিরাপত্তার জন্য অহিংস সংগ্রাম’ এর কারণে সিরলেফকেও দেয়া হয় শান্তি পুরস্কার৷
ছবি: T. Charlier/AFP/Getty Images
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরস্কারও বিতর্কের ঊর্ধে নয়
শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ অমানবিক অবস্থার জন্য বহু বছর ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বাস্তু নীতির সমালোচনা করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা৷ তারপরও ‘শান্তি, মীমাংসা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকার জন্য’ ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও দেয়া হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
12 ছবি1 | 12
আর্নোর বিরুদ্ধে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ফাঁস করারও অভিযোগ উঠেছে৷ তিনি সব ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন৷
যৌন কেলেঙ্কারির কথা জানাজানি হওয়ার পর ১৮ সদস্য বিশিষ্ট সুইডিশ অ্যাকাডেমির একাধিক সদস্য সরে দাঁড়ান অথবা সরাসরি পদত্যাগ করেন, যাদের মধ্যে সারা ডানিয়ুসও আছেন, যিনি ১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অ্যাকাডেমির প্রথম মহিলা প্রধান৷ ফ্রস্টেনসন নিজেও পদত্যাগ করেন৷ সুইডিশ অ্যাকাডেমি স্বীকার করে যে, ‘‘অকাঙ্খিত ঘনিষ্ঠতার মতো অগ্রহণযোগ্য আচরণ’’ ঘটেছে, কিন্তু এই স্বীকৃতি সত্ত্বেও অ্যাকাডেমির সুনামের যে হানি ঘটেছে, তা রোধ করা যায়নি – যে কারণে অ্যাকাডেমি দৃশ্যত এ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে৷
কারণ হিসেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বর্তমানে অ্যাকাডেমির সদস্যসংখ্যা, এবং অ্যাকাডেমির উপর জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পাওয়ার কথা বলেছে৷ পরবর্তী নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার আগে অ্যাকাডেমির উপর জনসাধারণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, বলেছেন অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব আন্ডার্স অলসন৷ দৃশ্যত ২০১৮ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ সালে প্রদান করা হবে – সেই সঙ্গে ২০১৯ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ীর নামও ঘোষণা করা হবে৷ নোবেল পুরস্কার নিধি এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে৷
‘‘নোবেল পুরস্কারের উপর সুইডিশ অ্যাকাডেমির সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে,’’ বলেছেন নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট কার্ল-হেনড্রিক হেলডিন৷ অ্যাকাডেমির সিদ্ধান্ত নোবেল পুরস্কারের দীর্ঘমেয়াদি সুনাম রক্ষা করতে সাহায্য করবে, বলে তিনি মন্তব্য করেছেন৷ আলফ্রেড নোবেল ১৯০০ সালে নোবেল পুরস্কার নিধি প্রতিষ্ঠা করেন৷
সুইডিশ অ্যাকাডেমি উল্লেখ করেছে যে, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ১৯১৫, ১৯১৯, ১৯২৫, ১৯২৬, ১৯২৭, ১৯৩৬ এবং ১৯৪৯ সালে একটি ‘‘সংরক্ষিত পুরস্কার’’ ঘোষণা করা হয় ও তার মধ্যে পাঁচটি পুরস্কার পরের বছরের পুরস্কারের সঙ্গে একযোগে প্রদান করা হয়৷