1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

২০২৪ : নির্বাচন, যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পরাজয়ের বছর

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০ ডিসেম্বর ২০২৪

বিদায় নিচ্ছে ২০২৪। বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিক কিছু নির্বাচন আর অস্থিরতার জন্য বছরটির ঘটনা প্রবাহগুলো বহুদিন ধরে আলোচনায় থাকবে।

Brasilien Amazonasgebiet mit extremer Trockenheit und Waldbränden
ছবি: Marizilda Cruppe/Greenpeace Brazil

বিশ্ব জুড়ে ক্ষমতার পটপরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ভবিষ্যতের জন্য চুক্তির মতো কূটনৈতিক সাফল্য থেকে শুরু করে শান্তি বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাসহ নানা কারণে ২০২৪ সালকে আমরা বলতে পারি ঐতিহাসিক উত্থান-পতনের বছর। বলতে পারি, ভাঙা-গড়ার বছর। বছর জুড়ে ছিল নির্বাচন আর যুদ্ধের জয়জয়কার। কিন্তু বিশ্বব্যাপী উগ্র ডানপন্থিদের বিস্তারে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় বছরটিকে পরাজয়ের বছর হিসেবে গণ্য করা যায়। রাজনৈতিক বৈরিতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার সাথে মিথ্যা তথ্য বা তথ্য বিশৃংখলার বাড়বাড়ন্ত ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনি বছরটিকে গণতন্ত্রকামী মানুষদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বিরাট প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। চরম মাত্রায় রাজনৈতিক মেরুকরণ আর নাগরিক পরিসর সঙ্কুচিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বছর জুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাত শুধু বাড়েনি, পাশাপাশি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আস্থার সঙ্কট ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৪ সালে ডানপন্থি পপুলিজমের বিস্তার, ঐতিহ্য ও  পরিবর্তন নিয়ে মেরুকরণের লড়াই, রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে আন্তর্জাতিক সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় আগত ২০২৫-এ বিশ্ব নেতাদের চিন্তারেখায় নতুন নতুন ভাঁজ ফেলবে।

২০২৪ সালকে জাতিসংঘ ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর' হিসেবে অভিহিত করেছিল। কারণ, এই বছরে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষের জন্য ভোট দেয়ার সুযোগ এসেছিল। দ্য আইডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ‘দ্য ২০২৪ গ্লোবাল ইলেকশন্স সুপার-সাইকেল' লাইভ রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, ইতিমধ্যে ২০২৪ সালে বিশ্বের ৭৪টি দেশের মধ্যে ৭৩টি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২৪ সালের বিশ্বরাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো, বছরটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ৫টি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যের ভোটাররা নতুন নেতা বেছে নিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড টাম্প নতুন করে ফিরে এসেছেন। আবার ভারত ও রাশিয়ায় নরেন্দ্র মোদি এবং ভ্লাদিমির পুতিন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছেন।

বিশ্বব্যাপী এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ছিল সবচেয়ে চমক জাগানিয়া। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্প একটি অনন্য রেকর্ড করেছেন। আমেরিকার ১৩০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে ট্রাম্প হলেন হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা প্রথম প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার রায়, নির্বাচনের আগে তাকে হত্যা চেষ্টাসহ নানা কারণে এই নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল সবচেয়ে বেশি। আদালত মে মাসে ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতির ৩৪টি অভিযোগের কারণে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে এক সমাবেশে ট্রাম্প একটি হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে যান। উপরন্তু ডেমোক্রেটদের চাপের মুখে জো বাইডেনের নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে যাওয়া এবং ফলশ্রুতিতে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকে একটি অনন্য মাত্রা দিয়েছিল।

২০২৩ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ভাষ্যকাররা ২০২৪ সালকে বলেছিলেন, এটি হবে ‘গণতন্ত্রের বছর'। কারণ কোনো একক বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে এত বিপুল সংখ্যক দেশে নির্বাচন এর আগে দেখা যায়নি। তবে বছর শেষে ২০২৪-কে আর গণতান্ত্রিক বছর বলা যাবে কীনা সেটি নিয়ে বিতর্ক তোলা যায়। বিতর্কের উর্ধ্বে গিয়ে একে ‘মেক অ্যান্ড ব্রেক ইয়ার' বা ‘ভাঙ্গা-গড়ার বছর' বলতে পারি। কারণ, এই বছরে দেশগুলোতে নির্বাচন হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে নির্বাচনগুলো কতটা মানুষের আশা পূরণ করতে পেরেছে, কতটা মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারছে – সেটি নিয়ে বিতর্ক চলছে। উল্টো আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক দেশে নির্বাচনের আগে ও পরে যে বিক্ষোভ এবং অসন্তোষ ছিল তা আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের উপর আস্থা কমার নজিরও কোথাও কোথাও দেখা গেছে। যেমন ভারতে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন, কিন্তু বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পারেনি। পরাজয়ের অন্ধকারে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকা কংগ্রেস কার্যত নতুন জীবন পেয়েছে দেশটির ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে।

২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী যে রাজনৈতিক অসন্তোষগুলো আমরা দেখেছি তার আলোকে বলা যায়, মানুষ যখন অসম বিশ্বে বাস করে, যখন দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় অনিয়ম বাড়ে তখন মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ে। ফলশ্রুতিতে সরকারের উপর আস্থা কমে যায়। এ কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি কঠিন বছর ছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত, স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক ইস্যুতে বিভক্তি এবং রাজনৈতিক স্থিতাবস্থায় ক্ষুব্ধ অনেক দেশের ভোটাররা হতাশার বার্তা পাঠাতে আমরা দেখেছি। বিশেষ করে যেসব দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ তার নিজের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারে না সেসব দেশে মানুষ ফুঁসে উঠেছে বেশি। এমন দেশগুলোতে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণাও এসেছে বেশি। ২০২৪ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অবধি অনুষ্ঠিত ৬৩টি দেশের নির্বাচনের মধ্যে ১৩ শতাংশ নির্বাচনে বিরোধীরা বয়কট করেছে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল ২০১৪ সালের মতো ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছে। ২০২৪ সালের ১৫ শতাংশ নির্বাচনে পরাজিত দল বা প্রার্থী প্রকাশ্যে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। ২৮ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনের পর বিক্ষোভ হয়েছে, ২০ শতাংশ নির্বাচনে সহিংসতার শিকার হয়ে বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানি ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোজাম্বিকে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদেরকে বৈধ বিজয়ী বলে ঘোষণা করে। অক্টোবরের নির্বাচনের পর থেকে দেশটিতে বিক্ষোভ ও সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।

এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা একটা শিক্ষা লাভ করি। সেটি হলো, নির্বাচন তখনই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যখন তা এমন একটি ব্যবস্থার অংশ হয় যেখানে জনগণ আইনের শাসনের অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার ব্যবহারে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রদান করে ও দুর্নীতি দমন করে। ২০২৪ সালে সারা বিশ্ব জুড়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ বেড়েছে। কার্নেগির গ্লোবাল প্রোটেস্ট ট্র্যাকার অনুসারে, বছরটিতে বিশ্বজুড়ে ১৬০টিরও বেশি উল্লেখযোগ্য সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, যার বেশিরভাগই ছিল ভোট সম্পর্কিত অভিযোগের প্রেক্ষাপটে। ২০২৪ সালে আমরা বিশ্বব্যাপী যে অস্বাভাবিকভাবে বিপুল সংখ্যক নির্বাচন দেখেছি, সেগুলোর ফলাফল ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নাগরিকদের ক্ষোভ একটি চালিকাশক্তি হিসাবে দাঁড়িয়েছিল। যেমন ফ্রান্সে নিউ ক্যালেডোনিয়ার ভোটার নিবন্ধন বিধিতে পরিবর্তনের বিরুদ্ধে, ঘানায় ভোটার তালিকার কারচুপির অভিযোগের বিরুদ্ধে, সেনেগালে নির্বাচনে বিলম্বের বিরুদ্ধে, তাঞ্জানিয়াতে বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চল ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে এবং টিউনিসিয়ায় নির্বাচনি বিরোধীদের দমনের বিরুদ্ধে, কমোরোস, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং ভেনিজুয়েলায় নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগে ঘন ঘন বিক্ষোভ হয়েছে। তবে কিছু দেশে ক্ষমতাসীনদের জন্য বছরটি কঠিন হলেও অনেক দেশে ঐতিহ্য ও পরিবর্তন নিয়ে মেরুকরণের লড়াইও আমরা দেখতে পেয়েছি। জর্জিয়া ও ভেনেজুয়েলায় বড় ধরনের নির্বাচনি জালিয়াতির বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা মসনদে টিকে গেছে। অনেক দেশে বিক্ষোভ সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও বিদ্যমান সমস্যাগুলো সামনের বছরে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।  

নির্বাচনি ক্ষেত্রের বাইরে সরকারগুলোর অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড অনেক জায়গায় নাগরিক অসন্তোষের সূত্রপাত করেছিল। গণমাধ্যমে দমন-পীড়নের কারণে ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি ও ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের দুর্নীতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ কোরিয়া এবং উগান্ডায় বিক্ষোভ হয়েছিল। ফৌজদারি তদন্ত বা গ্রেপ্তারের আকারে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আলবেনিয়া, বলিভিয়া, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানে বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছিল। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে বড় আকারের বিক্ষোভ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার, সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদের সরকারকে জনগণ ক্ষমতাচ্যুত করেছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি এবং সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা ছিল বাংলাদেশ, কেনিয়া এবং নাইজেরিয়ায়, যেখানে অর্থনৈতিক বিক্ষোভ সরকারের বৈধতার জন্য বড় আকারের চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছিল। পেনশন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় বরাদ্দ, শ্রম আইন, আবাসন ও পর্যটন নীতির বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ফিনল্যান্ড, ভারত, পর্তুগাল এবং স্পেনে মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত আছে।

নির্বাচন ক্ষেত্রের বাইরে ২০২৪ সালে বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও সংঘাত। বছরটিতে একদিকে আগে থেকে চলমান যুদ্ধ ও সংঘাতগুলো যেমন বেগবান হয়েছে, তেমনি নতুন করে সংঘাতের উপলক্ষ তৈরি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বছরে পদার্পণ এবং ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধকে ঘিরে সংঘাত https://www.britannica.com/event/Israel-Hamas-War ছড়িয়ে পড়লে ২০২৪ সালে সামরিক সংঘাত অব্যাহত থাকে। বছরটিতে গাজা থেকে সুদান, ইউক্রেন পর্যন্ত সংঘাত এবং যুদ্ধের কারণে অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞ এবং ১৪ বছরের নৃশংস গৃহযুদ্ধের পরে সিরিয়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শিশু, নারীসহ নিরস্ত্র মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়াচ্ছে। ইজরায়েল-হামাসের গাজা সংঘাত বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সমঝোতা চুক্তি, নেতানিয়াহু ও হামাসের তিন শীর্ষ নেতাসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি কোনো কিছুই এই সংঘাতের লাগাম টানতে পারছে না। উল্টো সিরিয়াতে বাশারের পতনের পর ইজরায়েলের বাড়াবাড়ি বেড়েছেই বলা যায়। চলমান যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩৯ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। গাজা ফ্রন্টের সমান্তরালে ইসরায়েল ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে এবং প্রতিদিন আন্তঃসীমান্ত হামলা হচ্ছে। গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যার ঘটনা সংঘাতগুলোর মাত্রা ও পরিসর শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছে না, পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতা ও প্রতিহিংসা বাড়াচ্ছে। এই গুপ্ত হত্যাগুলো ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের রেশ অনেক দূর নিয়ে যাবে।

বরাবরের মতো ২০২৪ সালেও বিশ্বব্যাপী মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। পৃথিবী ১৯৮৯ সালের পর থেকে গত মে মাসে তার সবচেয়ে তীব্র ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। এর ফলে উপগ্রহ, পাওয়ার গ্রিড এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে। আটলান্টিক হারিকেন মৌসুম বছরের চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি বন্যা নতুন করে ভাবাচ্ছে। ইউরোপ, এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে বন্যা ও তাপপ্রবাহের কারণে এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হওয়া প্রায় নিশ্চিত। তারপরও জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় বিগত বছরগুলোতে যে উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল সেগুলোকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে ২০২৪ সালের কিছু নির্বাচনি ফলাফল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পটপরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থিদের জয়-জয়কারের কারণে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে ডানপন্থীদের নির্বাচনী বিজয়ের মধ্য দিয়ে ‘নির্বাচনে বড় পরাজয় হয়েছে জলবায়ুর'। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে ডোলান্ড ট্রাম্পের বড় জয় সামনের দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট মোকাবিলাকে ভাবনার মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ, তিনি জলবায়ু সঙ্কটকে ‘বড় ধাপ্পাবাজি' বলে মনে করেন। যুক্তরাজ্যে লেবারদের জয়, কিংবা ফরাসী নির্বাচনে ডানপন্থিদের পরাজয় আশার সঞ্চার করলেও ইউরোপে ডানপন্থি দলগুলো যারা জলবায়ু পদক্ষেপকে ব্যয়বহুল এবং অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করেছিল তারা ইইউ নির্বাচনে ভাল ফল করেছে। ইউরোপের রাজনীতি ও পপুলিজম বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন ফিয়েসচি মনে করেন, ‘এটা খুবই স্পষ্ট যে, বেশিরভাগ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে নির্বাচনে সবচেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে জলবায়ু'। বাস্তবতা হলো, ২০২৪ সালে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী গতিবেগ হ্রাস পেয়েছে। জলবায়ু সংকটের জন্য ২০২৪ সাল ছিল একটি উদ্বেগজনক বছর। আজারবাইজানের কপ-২৯ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনটি ছিল এক ধরনের কাগুজে আয়োজন। কারণ বেশিরভাগ বিশ্ব নেতারা এই সম্মেলনকে এড়িয়ে গেছেন।

প্রাকৃতিক বৈরি পরিবেশের সাথে মনুষ্য সৃষ্ট তথ্য বিশৃংখলার সাথেও বিদায়ী বছরটিতে বিশ্ববাসীকে লড়তে হবে। তথ্য বিশৃংখলা ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে মানুষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বছরটির শুরুতেই স্বল্পমেয়াদি হুমকি হিসেবে মিথ্যা তথ্যকে চিহ্নিত করেছিল। এর বাইরে ২০২৪ সালে লিঙ্গ এবং এলজিবিটিকিউ অধিকার নিয়ে অনেকগুলো প্রতিবাদ হয়েছে।  আফগানিস্তান, ব্রাজিল, ফ্রান্স, গাম্বিয়া, ইতালি, কেনিয়া, কিরগিজস্তান, সুইজারল্যান্ড এবং তুরস্কে নারী অধিকারের প্রতি হুমকি বা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিলে হাজার হাজার নারী এমন একটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যা নির্দিষ্ট গর্ভপাতকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে বিচারের অনুমতি দেবে। বুলগেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সার্বিয়ায় এলজিবিটিকিউ বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের কিছু ঘটনা আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। আলেক্সেই নাভালনি ও কুইন্সি জোনসের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে। একই সাথে ১৪ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর জুলিয়ান আসাঞ্জের মুক্তি পাওয়া আনন্দিত করে। ন্যাটোতে সুইডেনের প্রবেশ জোটটিকে শক্তিশালী করেছে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ২০২৪ সালে প্রথম বিধিমালা প্রয়োগ করে ইতিহাস তৈরি করেছে। যেটি সামনের দিনগুলোতে এআই সৃষ্ট সমস্যা ও জটিলতা মোকাবেলায় বিশ্বকে পথ দেখাবে। বিশ্বের প্রথম এমআরএনএ ফুসফুসের ক্যান্সার ভ্যাকসিনের মতো যুগান্তকারী ট্রায়ালগুলো স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের জন্য এক ঝলক আশার আলো দেখায়। এসব ঝলক কতটা স্থায়ী হবে তা নির্ভর করছে আগত বছরটিতে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে আন্তর্জাতিক সংঘাত কতটা কমে তার ওপর।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ