দেড়যুগ আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হচ্ছে হাইকোর্টে৷ মামলার রায় আগে হলেও এতদিন শুনানি হয়নি অন্যান্য মামলার দীর্ঘ জটের কারণে৷
বিজ্ঞাপন
বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে সোমবারের কার্যতালিকায় আলোচিত এই মামলাটি রয়েছে এক নম্বরে৷
নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষে চার বছর আগে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছিল, তবে উচ্চ আদালতে করা আপিল শুনানি এতদিন আটকে ছিল অন্যান্য মামলার দীর্ঘ জটের কারণে৷
এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করে দিলে রোববারও শুনানির কার্যতালিকায় উঠেছিল মামলাটি৷
গত আগস্টের মাঝামাঝি অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তির জন্য ‘অগ্রাধিকার' ভিত্তিতে শুনানির জন্য আবেদন করা হয়েছে৷ তাতে প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ ঠিক দেবেন বলে তখন তিনি আশা করেছিলেন৷
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়৷ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই মামলার রায় হয়৷
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে৷ আর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ সেইসঙ্গে ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন৷
যাঘটেছিলসেদিন
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল৷ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ৷
শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা৷ বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ৷ সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়৷ তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ৷
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা তখনও ভয়াবহতার মাত্রা বুঝে উঠতে পারেননি৷ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এগোতেই তারা দেখতে পান শত শত জুতো, স্যান্ডেল রাস্তায় ছড়ানো৷ তারই মধ্যে পড়ে রয়েছে মানুষের রক্তাক্ত নিথর দেহ; আহতদের আর্তনাদে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি৷
হামলায় আহতদের সাহায্য করতে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা যখন ছুটে গেলেন, তখন পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে৷ পুলিশ সে সময় হামলার আলামত সংগ্রহ না করে তা নষ্ট করতে উদ্যোগী হয়েছিল বলেও পরে অভিযোগ ওঠে৷ ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন৷
মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়৷
মামলা
হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন৷ থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়৷
ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির৷
জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়৷ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়৷
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে৷ সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন৷
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে সেই অভিযোগপত্রে ৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
বিভীষিকাময় একুশ আগস্ট
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে এই মামলার রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
নৃশংস হামলা
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালেই চালানো হয় হামলা৷ নেতা-কর্মীদের রক্তে ভেসে যায় চত্বর, মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করা হয় শেখ হাসিনাকে৷ প্রাণে বাঁচলেও, শ্রবণশক্তি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর৷ ওই হামলায় মহিলা লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন; আহত হন কয়েকশ’ নেতা-কর্মী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
দেশজুড়ে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ৷ বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে আসেন রাস্তায়৷ দেশজুড়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়, আগুন দেওয়া হয় অনেক জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বহুল প্রতিক্ষীত রায়
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ইতিহাসের ভয়াবহ এই হামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ জনের।
ছবি: Bdnews24.com
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ফাঁসি
এই হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে৷ হামলা পরিকল্পনায় ছিলেন ওই সরকারের উপমন্ত্রী, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু৷ এই দু’জনসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: Bdnews24.com
তারেকের যাবজ্জীবন
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এই হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সরাসরি অংশ নেওয়া জঙ্গি গোষ্ঠী হুজি’র নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান৷ রায়ে তারেক ছাড়াও খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: AP
দণ্ডিত কর্মকর্তারা
রায়ের সময় আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাগারে ছিলেন৷ ১৮ জন পলাতক ছিলেন। পরে দণ্ডিত দুই পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করায় ১৬ জন থাকেন পলাতক। এর মধ্যে এক দশক ধরেই যুক্তরাজ্যে রয়েছেন তারেক রহমান। তাকে ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। বাকি পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও অন্যরা৷
ছবি: Bdnews24.com
মুফতি হান্নান
একুশ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ জঙ্গি গোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে দায়ী করা হয় মুফতি হান্নানকে৷ নাশকতা চালিয়ে হত্যার এক মামলায় ২০১৭ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে জবানবন্দিতে এই হামলার পেছনে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
আব্দুল কাহার আকন্দ
ঘটনার চার বছর পর তদন্তে হাত দিয়ে এই হামলার পেছনের ঘটনা তুলে আনেন সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ৷ তাঁর দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷
ছবি: Bdnews24.com
জজ মিয়া
বিএনপি সরকারের আমলে এই হামলায় নোয়াখালীর নিরীহ যুবক মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়৷ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁর কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়৷ পরে অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী৷
ছবি: Bdnews24.com
মামলার সবশেষ
১৬ বছর আগের এই ঘটনার বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলা দু’টি এখন আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে৷ এর আগে কারাগারে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তিরা জেল আপিল করেছেন। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন ও আসামিদের আপিলের শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
এই মামলার রায়ের পর দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘‘এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রকাশ৷ আমরা এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখ্যান করছি৷’’
ছবি: Bdnews24.com
ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’
আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন এই ঘটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’ বলেই সংসদে আওয়ামী লীগকে কথা বলতেও ‘বাধা’ দিয়েছিল৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত একটি দল, যে দল দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই দলের একটা সভায় এমন একটা গ্রেনেড হামলা, আর পার্লামেন্টে যিনি সংসদ নেতা, লিডার অফ দ্য হাউস, প্রধানমন্ত্রী, সে দাঁড়িয়ে বলে দিল- ‘উনাকে আবার কে মারবে’৷