২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ২১ বছর: সুপ্রিম কোর্টে চলছে শুনানি
২১ আগস্ট ২০২৫
ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলার ২১তম বার্ষিকী আজ। ২০০৪ সালের এই দিনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে চালানো ওই হামলায় ২৪ জন নিহত এবং আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ–সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়।ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
১৪ বছর পর এ–সংক্রান্ত মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইন) মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত । ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঘোষণা করা সেই রায়ে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয় অন্য ১১ জনকে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়৷ তারপর হাইকোর্ট ওই রায় বাতিল করে দেন। আসামিদের খালাস দিয়ে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর এখন শুনানি চলছে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগে বুধবার চতুর্থ দিনের মতো শুনানি হয়। আজ বৃহস্পতিবারও শুনানি হয়েছে।
বিভীষিকাময় একুশ আগস্ট
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে এই মামলার রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
নৃশংস হামলা
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালেই চালানো হয় হামলা৷ নেতা-কর্মীদের রক্তে ভেসে যায় চত্বর, মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করা হয় শেখ হাসিনাকে৷ প্রাণে বাঁচলেও, শ্রবণশক্তি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর৷ ওই হামলায় মহিলা লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন; আহত হন কয়েকশ’ নেতা-কর্মী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
দেশজুড়ে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ৷ বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে আসেন রাস্তায়৷ দেশজুড়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়, আগুন দেওয়া হয় অনেক জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বহুল প্রতিক্ষীত রায়
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ইতিহাসের ভয়াবহ এই হামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ জনের।
ছবি: Bdnews24.com
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ফাঁসি
এই হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে৷ হামলা পরিকল্পনায় ছিলেন ওই সরকারের উপমন্ত্রী, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু৷ এই দু’জনসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: Bdnews24.com
তারেকের যাবজ্জীবন
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এই হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সরাসরি অংশ নেওয়া জঙ্গি গোষ্ঠী হুজি’র নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান৷ রায়ে তারেক ছাড়াও খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
ছবি: AP
দণ্ডিত কর্মকর্তারা
রায়ের সময় আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাগারে ছিলেন৷ ১৮ জন পলাতক ছিলেন। পরে দণ্ডিত দুই পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করায় ১৬ জন থাকেন পলাতক। এর মধ্যে এক দশক ধরেই যুক্তরাজ্যে রয়েছেন তারেক রহমান। তাকে ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। বাকি পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও অন্যরা৷
ছবি: Bdnews24.com
মুফতি হান্নান
একুশ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ জঙ্গি গোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে দায়ী করা হয় মুফতি হান্নানকে৷ নাশকতা চালিয়ে হত্যার এক মামলায় ২০১৭ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে জবানবন্দিতে এই হামলার পেছনে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
আব্দুল কাহার আকন্দ
ঘটনার চার বছর পর তদন্তে হাত দিয়ে এই হামলার পেছনের ঘটনা তুলে আনেন সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ৷ তাঁর দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷
ছবি: Bdnews24.com
জজ মিয়া
বিএনপি সরকারের আমলে এই হামলায় নোয়াখালীর নিরীহ যুবক মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়৷ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁর কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়৷ পরে অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী৷
ছবি: Bdnews24.com
মামলার সবশেষ
১৬ বছর আগের এই ঘটনার বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলা দু’টি এখন আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে৷ এর আগে কারাগারে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তিরা জেল আপিল করেছেন। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন ও আসামিদের আপিলের শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
এই মামলার রায়ের পর দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘‘এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রকাশ৷ আমরা এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখ্যান করছি৷’’
ছবি: Bdnews24.com
ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’
আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন এই ঘটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’ বলেই সংসদে আওয়ামী লীগকে কথা বলতেও ‘বাধা’ দিয়েছিল৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত একটি দল, যে দল দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই দলের একটা সভায় এমন একটা গ্রেনেড হামলা, আর পার্লামেন্টে যিনি সংসদ নেতা, লিডার অফ দ্য হাউস, প্রধানমন্ত্রী, সে দাঁড়িয়ে বলে দিল- ‘উনাকে আবার কে মারবে’৷
ছবি: PID
12 ছবি1 | 12
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ–সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এ ঘটনায় তখন মামলা হয়েছিল মতিঝিল থানায়। মামলার তদন্ত নিয়ে তখন নানা প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে নিরপরাধ ব্যক্তিকেও আসামি করার৷ ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু করে সিআইডি। সংস্থাটি ২২ জনকে আসামি করে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ–সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ মামলার রায় দেন। তাতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
ঘটনার ১৪ বছর পর বিচারিক আদালত এ–সংক্রান্ত মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইন) মামলার রায় দেন। গত বছর হাইকোর্ট ওই রায় বাতিল করে দেন।
এরপর হাইকোর্টে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল, জেল আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর শুনানি হয়। ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট সাজার রায় বাতিল করেন। ফলে মামলা থেকে সবাই খালাস পেয়ে যান।
তারপর ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে বলা হয়, দেশের ইতিহাসে এটা এক জঘন্য মর্মান্তিক ঘটনা, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতা আইভি রহমানসহ বহু মানুষ প্রাণ হারান। যাঁরা মারা গেছেন, তাদের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে তদন্ত হওয়া দরকার, যা এ মামলার ক্ষেত্রে এখনো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এ মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণের আলোকে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়।
পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) থেকে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে চলতি বছরের ১৭ জুলাই আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্যাহ আল মাহমুদ। আসামিপক্ষে রয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, মোহিনুর রহমান প্রমুখ।