২১ আগস্ট হামলা: ১৯ জনের ফাঁসি, ১৯ জনের যাবজ্জীবন
১০ অক্টোবর ২০১৮এই মামলায় জীবিত আসামি মোট ৪৯ জন৷ কাউকেই খালাস দেয়া হয়নি৷পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বুধবার রায় ঘোষণা করেন৷ রায়ের সময় ৩১ জন আদালতে হাজির ছিল৷ বাকিরা পলাতক৷ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে৷
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷তিনি গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন ২৪ জন৷ আহত হন দু' শতাধিক৷ বিএনপির সরকারে আমলে এই মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়৷ পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মামলার ফের তদন্ত হয় এবং সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়৷
মামলায় মোট আসামি ৫২ জন৷ এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের অন্য মামলায় আগেই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে৷ বাকি আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাবন্দি৷ ১৮ জন পলাতক৷
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জমান বাবর, এনএসআই'র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, শেখ আবদুস সালাম, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল সালাম পিন্টু, আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউছুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা ওরফে জিএম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবউল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গির আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামীম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামীম ওরফে রাশেদ, মো. উজ্জল ওরফে রতন এবং হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ৷ এর মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও মোহাম্মদ হানিফ পলাতক রয়েছেন৷ বাকি ১৭ আসামি কারাগারে আছেন৷
এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি চেয়াপার্সনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷একইসঙ্গে আরো ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল রায়ের পর সাংবাদিকদের জানান, ‘‘আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল৷ আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত৷ তারেক রহমানের হাওয়া ভবনে বসে এই হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান মূল ষড়যন্ত্রকারী৷'' তারেক রহমান এখন লন্ডনে পলাতক আছেন৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘আমরা এই রায়ের ব্যাপারে আপিল করে তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন জানাব৷''
এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেছেন, ‘‘আমরা এই মামলায় ন্যায় বিচার পাইনি৷ বিএনপি সরকারের আমলেই এই মামলার তদন্ত শুরু হয় এবং আসামিরা গ্রেপ্তার হয়৷ পরে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয় হয়৷ তারেক রহমান এই ঘটনায় জড়িত নয়৷ তাকে খালাসের পরিবর্তে অন্যায়ভাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ তিনি সময়মতো দেশে ফিরে আত্মসমর্পন করে আপিল করবেন৷''
এই মামলায় সবচেয়ে আলোচিত সাক্ষী জজ মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি এই রায়ে খুশি৷ আমাকে সিআইডির কর্মকর্তারা নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল৷ এখন প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ হয়েছে৷ তবে আমি এখনো জীবনের নিরপত্তাহীনতায় ভুগছি৷''অন্যদিকে ২১ আগস্টের ঘটনায় গুরুতর আহতদের একজন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী মাহবুবা ইয়াসমিন৷ তিনি শরীরে ১৮শ' স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই রায়ে আমি পুরোপুরি খুশি হতে পারিনি৷ তারেক রহমানের ফাঁসির আদেশ হলে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারতাম৷''
এদিকে এই রায়কে ‘ফরমায়েশি রায়' বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷ তিনি বলেন, ‘‘এই রায় আমরা প্রত্যাখ্যান করছি৷ এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক৷ ক্ষমতাসীন দলের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই রায় দেওয়া হয়েছে৷ জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, সরকার তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করে আরেকটি মন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো৷ যেমনটি করেছে মিথ্যা মামলায় দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়ে৷'' বিএনপি এই রায়ের বিরুদ্ধে ৭ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে৷
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘‘বিলম্বিত হলেও এ রায়ে আমরা অখুশি না৷ কিন্তু আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট না৷ কারণ, এই রায়ে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমানের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি৷ তার সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত ছিল৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘অপারেশন চালানোর জন্য তারেক রহমানের নির্দেশ ছিল৷ মুফতি হান্নান নিজেই এ নিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন৷''