ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে বুধবার রাতে হত্যার পর বৃহস্পতিবার রাতে হত্যা করা হয় এক নারীসহ তিনজনকে৷
বিজ্ঞাপন
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুক্রবার বলেন, ‘‘এক দিনের ব্যবধানে সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী এবং মগবাজারে তিন খুনের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত৷ তাই এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে৷''
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘‘ঘরের মধ্যে এসে মানুষ খুন করে যাবে, এ অরাজকতা চলতে পারে না৷ এ ব্যাপারে পুলিশ বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে৷''তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল তা মোটেও মনে করেন না৷ তিনি মনে করেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে৷ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘এসব ঘটনায় মোটেও বলা যাবে না যে রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে৷''
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
তিনি এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দাবি করে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ আমরা দোষীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা করছি৷ যে বা যারাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন এবং যে ইস্যুতেই এ খুনের ঘটনা ঘটুক না কেন দ্রুত খুনিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে৷'' এ নিয়ে সাংবাদিকদের ‘অপপ্রচার' না চালাতেও অনুরোধ করেছেন প্রতিমন্ত্রী৷
সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ও একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গত বুধবার রাত আটটার দিকে দুর্বৃত্তরা পূর্ব রাজাবাজারের দোতলার ভাড়া বাসায় ঢুকে স্ত্রী ও স্বজনদের আটকে রেখে গলা কেটে হত্যা করে৷ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি৷ ফারুকী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ছিলেন৷
বৃহস্পতিবার ভোরে ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন৷ ফারুকীকে খুন করে বাসা থেকে ছয় লাখ তিন হাজার টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়৷ শেরেবাংলানগর থানার পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব হত্যাকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখছে৷ মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি৷ তবে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে৷
তবে তিনি দাবি করেন, ফারুকীর ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে বিরোধিতা, পারিবারিক সমস্যা, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, হজে লোক পাঠানো নিয়ে বিরোধিতার জের ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে৷ এদিকে, ফরুকী হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মগবাজারে বৃহস্পতিবার রাতে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা৷ নিহত তিনজন হলেন রানু আক্তার, বিল্লাল ও মুন্না৷ নিহত রানুর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, চাঁদা না পেয়ে স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷
পুলিশের উপকমিশনার ইকবাল হোসেন দাবি করেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধ ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কালা বাবু গুলি করে তিনজনকে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ৷ পুলিশ তিনজনকে হত্যার ঘটনায় শুক্রবার দুই নারীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে৷ তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন কালা বাবুর চাচী৷ পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, ‘‘চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে৷ অপরাধীরা অচিরেই ধরা পড়বে৷'' তিনি বলেন নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক এবং তৎপর আছেন৷