1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

২৪ বছর কাটছে, ক্রিকেট কথা রাখেনি!

এম এম কায়সার, সম্পাদক, স্পোর্টস বাংলা
এম এম কায়সার
১৮ অক্টোবর ২০২৪

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। টেস্ট ক্রিকেটে ওটা ছিল বাংলাদেশের অভিষেকের দিন। এখন চলছে ২০২৪-এর অক্টোবর। কদিন বাদেই টেস্ট অভিষেকের দু'যুগ পূর্তি উদযাপন করবে বাংলাদেশ।

২০০০ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও নিজের অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর আমিনুল ইসলাম বুলবুলছবি: JEWEL SAMAD/AFP

-উদযাপন, নাকি যন্ত্রণায় ঔষধ?

স্পষ্ট মনে আছে, টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের পথচলার প্রথম যুগ পূর্তিতে হাবিবুল বাশার সুমনকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘যেমন চেয়েছিলেন তেমন কিছু কি পেলেন এই সময়টায়?'' টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম হাফসেঞ্চুরিয়ান হাবিবুল ততদিনে অবশ্য ক্রিকেটকে গুডবাই জানিয়েছেন। ছিলেন নির্বাচকের নতুন দায়িত্বে। স্মৃতি টেনে এনে হাবিবুল বাশার বলছিলেন, ‘‘ঠিক যেখানে আমাদের থাকার কথা ছিল, যাওয়ার কথা ছিল, ক্রিকেটের সেই ঠিকানায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। তবে আমি হতাশ নই। আমার তো মনে হয় কিছুদিন পরই আমরা সঠিক পথ খুঁজে পাবো। আপনি এখন নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন সেই  ‘কিছুদিন'টা কবে? আমার উত্তর হবে- অপেক্ষা করুন আরো দুই থেকে তিন বছর। আমরা ঘুরে দাড়াবোই।''

সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনকে করা সেই প্রশ্ন এবং তার উত্তরের পর মাঝে ফাঁক গলে পেরিয়ে গেছে আরেকটি যুগ। আরো ১২ বছর গত।

-হাবিবুল বাশার, আমরা কি ঘুরে দাড়াতে পেরেছি?

পরিসংখ্যান, পারফরম্যান্স এবং সাফল্য নিরীক্ষার রেখচিত্র বলছে, আমরা পারিনি। এখনো টেস্ট ক্রিকেটে আমরা পথহারা দল। এখনো টেস্টে আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে হেরে যাওয়া দল। হ্যাঁ, বলতে পারেন, এর মাঝে তো আমরা টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছি। অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করেছি। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওদের বিরুদ্ধে এক টেস্ট জিতেছি। শেষ সাফল্য হিসেবে পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছি।

মানছি, এগুলো সাফল্য। তবে সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু আফগানিস্তানের কাছেও টেস্ট ম্যাচে হেরেছি। সর্বশেষ ভারতের মাটিতে দুই টেস্ট সিরিজে গোটা বাংলাদেশ দল যে নুয়ে পড়া ক্রিকেট খেলেছে তাতে টেস্ট ক্রিকেটই লজ্জিত হয়েছে! লাগাতার ও অস্বস্তিকর এবং আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে একপেশে হারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নামের পাশে যোগ হওয়া যৎকিঞ্চিৎ সাফল্যের অ-ধারাবাহিকতা এমনই যে আপনি অনায়াসেই সমালোচনার সুরে বলতে পারেন- এ তো ফ্লুক! ১৪৬ টেস্টে জয় মাত্র ২১টিতে। হারের সংখ্যা সেঞ্চুরি পেরিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০৭-এ।

দুই যুগ। দেড়শ'র কাছাকাছি টেস্ট ম্যাচ। অভিজ্ঞতা তো বেশ হলো। কিন্তু অর্জন কতটুকু? ছোট্ট একটা হিসেব দেই। আগে ১০ দলে বাংলাদেশ ছিল র‌্যাঙ্কিংয়ে দশম। এখন টেস্ট খেলে ১২টি দল। বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

একে আপনি উন্নতি বলবেন, নাকি শুরুর সেই শূন্যতেই এখনো বৃত্তবন্দি?

এখনো কি এই ফরম্যাটে পরিণত হতে পেরেছে বাংলাদেশ? দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অর্জন-বিসর্জন, আনন্দ- বেদনা, উন্নতি-অবনতির রেখচিত্র পরিষ্কার জানাচ্ছে- না পারেনি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের লম্বা সময় ধরে নবিশি আচরণ ও শিশুতোষ ভুল এবং মানিয়ে নিতে না পারার ক্রমাগত ব্যর্থতায় এই ফরম্যাটে আমরা ‘বাজে ছাত্র'-এই ব্র্যাকেটে আটকে আছি।

ব্যক্তিগত কৃতিত্বের কল্যাণে পেছনের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো-সখনো মর্যাদাপূর্ণ শিরোনাম পেয়েছে।  তবে বেশিরভাগ সময় এর উল্টোপিঠ দেখেছে। ক্রিকেটে দিন শেষে সাফল্যের হিসেব হয় ফলাফল দিয়েই। আপনি যতই প্রক্রিয়ার গুণগান গান না কেন, নিক্তিতে সাফল্য যোগ না হলে সেই পরিশ্রম কেউ মনে রাখে না। টেস্ট ক্রিকেটের সেই অঙ্কে বাংলাদেশ একেবারে শুরুর সময় থেকে পিছিয়ে। আজ ২৪ বছর ধরে টেস্ট খেলে আসার পরও সেই কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়াই রয়ে গেল! এখনো এই ফরম্যাটের  অ, আ, ই, ঈ- পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। মাথা দুলিয়ে নামতা মুগস্থ করার ভঙ্গিতে!

এই দুই যুগেআমাদের টেস্ট ক্রিকেটের হিসেবটা পরিষ্কার- এই ফরম্যাটে অর্জনের তুলনায় অসাফল্যের ওজনটা বেশি। কিছু কীর্তি আছে। কেলেঙ্কারিও আছে কিছু। কদাচিৎ কিঞ্চিৎ সুখ মিলেছে। তবে বেশিরভাগ সময় কেটেছে ব্যর্থতায়, বেদনায়। প্রতিপক্ষের অর্জনে হাততালি দিয়ে আমরা এই লড়াইয়ে নেহাৎ অংশগ্রহণকারী দল মাত্র! আর তাই এখনো ২৪ বছর বয়সি টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ককে প্রায়শই ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে এসে বলতে হচ্ছে, ‘‘আমরা শিখছি। লার্নিং কার্ভ!''

সমস্যা হলো, আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে সবাই শিখে এসেই যোগ দেয়। এখানে তখন তাদের একটাই কাজ- শেখার প্রয়োগ দেখিয়ে সাফল্য তুলে নেয়া। আর তখন বাংলাদেশ নখ খুঁটে লাজুক ভঙ্গিতে বলছে, ‘‘আমরা শিখছি!'' এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেয় প্রতিপক্ষ যেন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আর বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনো প্রাথমিকের গণ্ডিতে আটকে থাকা আদু ভাই!

ক্রিকেটে সাফল্যের বিবেচ্য হিসেবে ধারাবাহিকতাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তুল্যমূল্যের নিরিখে লড়াই এবং জম্পেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই মূলত আমলে নেওয়া হয়। এই দুটো ক্ষেত্রেই পেছনের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ ব্যর্থ- ভয়াবহভাবে ব্যর্থ! একটা-দুটো সাফল্য এসেছে কালেভাদ্রে, যা মোটেও স্থায়ী কিছু নয়। টেস্ট ক্রিকেটে লড়াইয়ের মাঠে বাংলাদেশের অবস্থা পুরোপুরি পাঞ্চিং ব্যাগের মতো। যে বেচারা প্রতিনিয়ত ঘুষি খেয়ে বিধ্বস্ত। টেস্ট অঙ্গনে বাকি সব প্রতিপক্ষ শক্তির তুলনায় এত বেশি পেশিবহুল যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এদের সামনে বড্ড বেশি রোগা দেখায়। টেস্টে পা রাখার সেই শুরুর দিনগুলোতে বাংলাদেশ ম্যাচ পাঁচদিনে নিয়ে যেতে পারলেই মনে করা হতো অনেক কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে।

কী আশ্চর্য, ২৪ বছর পরে এসেও এখন সেই কৃতিত্বেই অনেক প্রাপ্তি ও সুখ খুঁজে বেড়ায় বাংলাদেশ দল! তাহলে আমরা কি সামনে এগোলাম, নাকি যেখানে ছিলাম সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে?

টেস্টে আমরা কেন ভালো করতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তরে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক সবাই বারবার বলেছেন, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট ঠিক করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভালো করার মূল প্রস্তুতির মঞ্চ দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট। কিন্তু যে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উইকেটে দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হচ্ছে, সেখানে যে মানের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, সেটা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে মোটেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়।

তিন ফরম্যাটের মধ্যে মুমিনুল হক শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেট খেলেন। সেই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন,‘‘আপনার কাছে কি মনে হয় ফার্স্ট ক্লাস ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের মান সমান? আমি বুঝি, কারণ, আমি ৫০-এর বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলছি। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, তবে এটাই সত্যি যে, আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে অনেক তফাৎ। আকাশ-পাতাল তফাৎ। এটা আমি আপনি সবাই জানে। এটা অজুহাত না, এটাই সত্যি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি অতটা চ্যালেঞ্জ ফেস করি না, যতটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেস করি।''

প্রস্তুতির মঞ্চটাই তো ঠিক নেই। সহজ হিসেব হলো, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোকে যতদিন পর্যন্ত শক্তিশালী এবং যুৎসই করা না হবে, ততদিন আমরা এমন পিছিয়ে পড়া দল হয়েই থাকবো। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট শেখার জায়গা না। এটা পারফর্ম করা এবং পারফরম্যান্স দেখানোর জায়গা। আপনি ঘরোয়া ক্রিকেটে সেটা শিখে এসে এখানে পারফরম্যান্স দেখাবেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা এখনো সেই সত্যটা ঠাহর করতে পারিনি। আর তাই এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা শেখার পর্যায়ে রয়ে গেছি।

দুর্বল পরিকাঠামো, পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব, পরিচালনায় পেশাদারিত্বের সংকট, নিজস্ব ক্রিকেট সম্পদ, মস্তিস্ক এবং তাদের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর আস্থাহীনতা, দ্রুত ছাঁটাই, অতিরিক্ত বাছাই, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে অনাদার-অবহেলা, বছরব্যাপী প্রতিভা অন্বেষণের কার্যকর তাগিদের অভাব, সর্বোপরি ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচের মচ্ছব। ক্লাব কর্তাদের মর্জিতে আম্পায়ারদের আঙুল তোলার দাসত্বগিরি- এসব অনাচার ও কুপ্রথা আমাদের বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের সম্ভাবনাকে ক্রমশ শূন্য এবং ফোকলা করে দিচ্ছে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের মানের এই ব্যবধান যতদিন না ঘুচবে, ততদিন আমরা এমন ‘বেচারা' হয়েই থাকবো।

দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে এখনো তাই সেই শূন্যতেই বসবাস! হাবিবুল বাশার আপনার সেই ‘কিছুদিন' আর কত দুরে?

২৪ বছর কাটলো, আমাদের টেস্ট ক্রিকেট কিন্তু কথা রাখেনি!

এম এম কায়সার সম্পাদক, স্পোর্টস বাংলা
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ