ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের অন্তত ২৫ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট টাকা দিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে র্যাব৷
বিজ্ঞাপন
তবে সম্রাট যাদের নাম বলেছে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করেননি সংশ্লিষ্ট র্যাব কর্মকর্তারা৷ তারা বলছেন, সম্রাটকে আবারো রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানিয়ে সোমবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে৷
রমনা থানায় করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় সম্রাট ১০ দিন এবং তাঁর সহযোগী এনামুল হক আরমান পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন৷ র্যাব-১ কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাতে এক প্রতিবেদনে দৈনিক প্রথম আালো লিখেছে, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছেন, মতিঝিলের ছয়টি ক্লাব থেকে তিনি প্রতি সপ্তাহে ৫০–৬০ লাখ টাকা চাঁদা পেতেন৷ ক্যাসিনোর পাশাপাশি গুলিস্তানের ছয়টি মার্কেট থেকে তোলা চাঁদার টাকাও তাঁর কাছে আসত৷ মতিঝিল ও গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ–ছয় লাখ টাকা করে পেতেন তিনি৷ এসব টাকার হিসাব-নিকাশ রাখতেন আরমান৷ আরমান সেই টাকার ভাগ বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দিতেন৷ যাদের টাকা দিয়েছেন, তাঁদের সবার নাম র্যাবকে বলেছেন সম্রাট৷ র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷''
অভিযানে আলোচনায় ক্যাসিনো
বাংলাদেশে ক্যাসিনোয় মদ, জুয়া চলছে অনেক দিন ধরে৷ তবে বুধবার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হবার পর ক্যাসিনোই হয়ে গেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’৷ বাংলাদেশে ক্যাসিনোের বিস্তারের ইতিহাস নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ক্লাবে ক্লাবে মদ, জুয়া
আয়ের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অনেক ফুটবল ক্লাবে ‘হাউজি’ খেলা শুরু হয় আশির দশকের দিকে৷ তবে নব্বইয়ের দশকে জুয়ার আসরও জমে ওঠে৷ গত কয়েক বছরে তা আরো ভয়াবহ মাত্রা পায়৷ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক ক্লাবেই গড়ে ওঠে ক্যাসিনো৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রতিবেদনে ক্যাসিনো
জাতীয় দৈনিকে ক্যাসিনো নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন নজরে আসে ২০১৩ সালে৷ প্রথম আলো-র সেই প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, ‘‘বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ‘ইনডোর গেমস’-এর নামে জুয়া খেলা চলছে৷’’
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
এগিয়ে থাকা ঢাকার কিছু ক্লাব
ছয় বছর আগে প্রথম আলো’র সেই প্রতিবেদনে ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড-এর নাম এসেছিল৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ঢাকার বাইরেও...
বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও তখন থেকেই নিয়মিত জুয়ার আড্ডা বসছে বলে জানা যায়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
আরো প্রতিবেদন
২০১৭ সালে দৈনিক বণিক বার্তা ‘অবৈধ তবু বড় হচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে তুলে ধরা হয় ক্লাবভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতেও পশ্চিমা ধাঁচের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা জমে ওঠার তথ্য৷ বলা হয়, প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোতে প্রতি রাতে বসানো হচ্ছে জুয়ার আসর৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
বিচ্ছিন্ন অভিযান
এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি দু-একটি ক্লাবে অভিযান চালালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং ক্যাসিনোর বিস্তার আরো বেড়েছে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক বৈঠকে দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন৷ আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে৷ আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন৷ এসব বন্ধ না করলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে৷
ছবি: DW
যুবলীগের ৬০টি ক্যাসিনো?
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর যুবলীগ নেতারা ৬০টি জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনো চালাচ্ছেন বলে কয়েকটি সংবাদপত্র জানায়৷ এরপরই ক্যাসিনোতে অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
যুবলীগ নেতা আটক
ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব৷ গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ একই দিনে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে দুই নারীকর্মীসহ ১৪২ জনকে আটক ও ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
অভিযান চলছে
শুক্রবার যুবলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে র্যাব৷ বুধবার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারের একটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব৷ এ পর্যন্ত ১৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
মোহামেডান, ভিক্টোরিয়াতেও ক্যাসিনো!
রোববার ঢাকার মতিঝিলে চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ৷ ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে জুয়া খেলার নয়টি বোর্ড, এক লাখ টাকা, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ পাওয়া গেছে। দুটো রুলেট টেবিল, নয়টি বোর্ড, বিপুল পরিমান কার্ড পাওয়া গেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে৷ এছাড়া আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেট টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। এর আগে শনিবার চট্টগ্রামে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
ক্যাসিনোতে রাজনীতির প্রভাব
ক্যাসিনো প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ও অন্য দলের নেতাদের নামও উঠে এসেছে৷ ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন আর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী সাব্বির সাধারণ সম্পাদক৷ রাশেদ খান মেননের দাবি, ক্লাবে যে ক্যাসিনো চলছে তা তিনি জানতেন না৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
12 ছবি1 | 12
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, সম্রাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন এবং অনেকের নামও বলেছেন৷ এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে৷ পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আরমানকে সোমবার আবার রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করা হবে৷
সম্রাট ও আরমানকে কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে গত ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে র্যাব৷ সেখানে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়ায় আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়, আর সম্রাটের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই দিন দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অভিযান চালান৷ এই ভবনে থাকা সম্রাটের কার্যালয়ে ক্যাঙারুর চামড়া পাওয়া যাওয়ায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ গ্রেপ্তারের পর দুজনকেই যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।