1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘৩০ লক্ষ শহিদের জন্য কাঁদার কেউ নেই’

১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাবা-মা আর তিন ভাইকে হারিয়েছেন সাইদুর রহমান৷ শহিদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি৷ বিজয়ের এই মাসে ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন একাত্তরের স্মৃতি, বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর বেদনার কথা৷

Bangladesch feiert den Tag der Unabhängigkeit
ছবি: DW

কবি আসাদ চৌধুরী রচিত অনবদ্য পঙক্তি – ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?' হ্যাঁ, অনেকটা এমনই আভাস পাওয়া গেল সাইদুর রহমানের কথায়৷ সাইদুর রহমান শহিদের সন্তান এবং প্রজন্ম '৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি৷ চ্যানেল আই-এর সংবাদ যাঁরা নিয়মিত দেখেন, তাঁদের কাছে ভীষণ পরিচিত একটি মুখ৷ এর পাশাপাশি তিনি একজন ব্যাংকার৷ তবে মনে-প্রাণে তিনি একজন দেশপ্রেমী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে নিয়েই দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান৷ একাত্তরে পরিবারের প্রায় সবাইকে হারানো সাইদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷

ডয়চে ভেলে: একাত্তরের এপ্রিলে যখন আপনার পরিবারের উপর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে, তখন আপনার বয়স কত ছিল? সে দিনের ঘটনা আপনার কতটা মনে আছে?

সাইদুর রহমান: আমরা তখন সৈয়দপুরে থাকি৷ সেখানকার রেলওয়ে ওয়ার্কশপে আমার বাবা মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তখন অফিস করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ লন্ডনে সেসময় আটজন প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল, এর মধ্যে আমার বাবা ও অন্য একজন ছাড়া বাকিরা সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের৷

Saidur Rahman Cried - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

এই যে বৈষম্যগুলো, এগুলো বাবার মনে আঘাত দিতো৷ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দোতলা বাংলোতে থাকতাম আমরা৷ সেই বাংলোগুলোর ছাদ থেকে এক রকমের তার মাটি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, যা বজ্রপাত রোধ করার জন্য লাগানো থাকতো বলে জানতাম আমরা৷ আমার বাবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঐ তারে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা টাঙিয়েছিলেন৷ এ সব নানা কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকাররা বাবাকে ভালো চোখে দেখেনি৷ দু'বার বিহারীরাসহ আর্মিরা এসে আমাদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়৷ কিছু না পেয়েও আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়, কারণ, আমার তিন ভাই তখন কলেজ ও হাইস্কুলে পড়ে৷ বাবার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাসায় অস্ত্র আছে কিনা৷ পরে ছেড়েও দেয়৷

১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল ছিল পহেলা বৈশাখ৷ তখন আমার বয়স ১০ বছর৷ আমি পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছি৷ সেদিন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং বিহারীরা মিলে সৈয়দপুরে গণহারে মানুষ হত্যা করে৷ বেলা ১১ টার দিকে আমাদের বাসায় ঢুকে প্রথমে আমার বাবাকে হত্যা করে তারা৷ বাবা আমাদের বলেছিল খাটের তলার লুকিয়ে থাকতে৷ বাবা আমাদের ঘরের দরজা আগলে দাঁড়িয়েছিলেন৷ ওরা শাবল দিয়ে ব্রিটিশ আমলের সেই ভারি দরজা ভেঙে ফেলে৷ বাবার পেটে বেয়নেট চার্জ করলে বাবা ওখানেই শাহাদাৎ বরণ করেন৷

সেটা দেখে আমার মা খাটের নীচে থেকে চিৎকার করে বেরিয়ে আসেন৷ আমার মাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে৷ দোতলার সিঁড়ি বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আমার মা-কে বেয়নেট চার্জ করে৷ আমার মা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যান৷ আমার মা চিৎকার করছিলেন আর বলছিলেন, ‘‘আমাকে মেরে ফেলো, আমার বাচ্চাদের মেরো না৷'' ওরা বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে এবং ‘জয় বাংলা' স্লোগানের কথা তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল৷ এরপর তারা মাকে নিয়ে যায় আমার বাবার হাতে গড়া শখের বাগানে৷ সেখানে আহত অবস্থায় আমার মাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলে তারা৷

এই কথাগুলো আমি বলতে চাই না৷ কারণ আমার ভীষণ কষ্ট হয়৷ যেদিন বলি, সেদিন আমাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়৷

মাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমার বড় ও মেজো ভাই বেরিয়ে আসে৷ ওদেরকেও বেয়নেট চার্জ করা হয়৷ ওরা মনে করেছিল আমরা সবাই মরে গেছি৷ আমাকে বুট দিয়ে লাথি মেরেছিল, তাই আমার গায়েও রক্ত লেগেছিল৷ ওরা চলে যাওয়ার পর ভাই ডাকার পর ওরা জবাব দিয়েছিল৷ আড়াই বছর বয়সি ছোট বোনটাও বেঁচে গিয়েছিল৷ আমি তখন ছোট হলেও সেই অবস্থায় তিন ভাইকে রেলওয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ তিনদিন ওরা ওখানে বেঁচে ছিল৷ পরে যখন ঘাতকরা জেনেছে, তখন তাদের মিথ্যা কথা বলে বের করে নিয়ে গিয়ে পেছনের একটা গর্তে ফেলে জবাই করে মেরে ফেলে৷ স্বাধীনতার পরে আমরা এ ঘটনা জানতে পেরেছি৷ ৭১ সালে বিহারীরা অনেক বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে রেলওয়ের যেখানে যন্ত্রপাতি বানানো হয়, সেই লোহা গলানোর ব্লাস্ট ফার্নেসে (৩৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে) জীবন্ত ফেলে হত্যা করেছে৷

15th April 1971 saidur - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

প্রজন্ম '৭১ তো আপনার হাতে গড়া৷ এমন একটি সংগঠন যে প্রয়োজন, এটা আপনার কেন মনে হলো? কেন মনে হয়েছিল যে, এমন একটা সংগঠন করা উচিত?

আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন আমার হলের কক্ষে ৩০ জন বুদ্ধিজীবীর একটি পোস্টার ছিল৷ সেই পোস্টারের দিকে তাকাতাম আর মনে হতো, এঁদের সন্তানরাও তো আমার মতো অসহায়৷ আমি দেখেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের শহিদ পরিবারগুলো কতটা অবহেলিত৷ ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন ঐ পরিবারগুলোর সূর্য৷ তাঁদের যখন পাকিস্তানিরা বা রাজাকাররা হত্যা করল, ঐ পরিবারে যে অমাবস্যা নেমে এলো, আজকে ৪৬ বছরেও ঐ পরিবারে ভোর হয় না৷ অনেক সম্ভাবনাময় পরিবার শেষ হয়ে গেছে৷ এই সব চিন্তা থেকেই সংগঠনটি করার কথা মাথায় আসে৷ ভাবলাম, শহিদ পরিবারের সন্তানদের একত্রিত করবো৷ গণমাধ্যমের দরুণ আমরা ঢাকার গুটিকতক বুদ্ধিজীবী পরিবারকেই চিনতাম৷ ঢাকায় আসি আমি চাকরির সুবাদে৷ অফিস শেষে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত আমি এদের খুঁজে খুঁজে বের করেছি৷ আমি যখন এই পরিবারগুলোর কাছে গেছি, তখন আমাকে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রীদের কাছে তাঁদের সন্তানদের ‘ভিক্ষা' করেছি বলা যায়৷ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করেছি৷ অনেকেই মনে করেছেন, স্বামী হারিয়েছি, এখন সন্তানদেরও হারাতে চাই না৷ তখন আসলে মুক্তিযুদ্ধবৈরী পরিবেশ ছিল৷ কিন্তু আমি জোঁকের মতো লেগে থেকে এই সংগঠনটি করেছিলাম৷ ১৯৯১ সালের ২৯শে অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে প্রজন্ম '৭১ গঠন করা হয়েছিল৷

এটি গড়ার কারণ ছিল – মুক্তিযুদ্ধ যে একটা বাস্তব বিষয়, এটা যে গল্প নয়, সেই চেতনা ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একাত্তরে যে অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেটাকে ফিরিয়ে আনা৷ আমাদের একটা স্লোগানই ছিল যে, ‘‘আমরা চাই ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন, অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন৷'' ৩০ লক্ষ শহিদের উপর ভর করে যে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে, তারা তো কিছু করলো না৷ ২০ বছরে কোনো সরকার এই শহিদ পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোনো সাহায্য করেনি৷ ফলে সেই চিন্তা চেতনা থেকেই প্রজন্ম ৭১ গড়ে তুলেছিলাম৷

প্রজম্ম একাত্তর বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সচেতন করতে কী ভূমিকা রাখছে?

আমি গণ আদালতের ৭ নম্বর সাক্ষী ছিলাম৷ কিন্তু শহিদ পরিবারগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা ছিল, সেটা (বাস্তবায়ন) করা যায়নি৷ আমার ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির ২০-২২ জনই ছিলেন পরিচিত বুদ্ধিজীবীর সন্তান, যেমন শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার, সিরাজ উদ্দীনের ছেলে৷ আমার যেটা খারাপ লাগতো, সেটা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিভিন্ন দলে' ভাগ করা৷ যে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, তাঁদের সম্মান জানানোর জন্য বছরের ৩৬৫ দিনে তাঁদের জন্য একটি দিবস নেই৷ আমি তাই একটি নির্দিষ্ট দিবস চেয়েছিলাম, যেটা এই শহিদদের সম্মান জানাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হবে৷ ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে হয়ত ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হবে৷ এমনটা হলেই না নতুন প্রজন্মের মধ্যে চেতনা জাগ্রত হবে৷ এতে করে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে যে, একটি দেশের জন্য প্রাণ দিলে সেই ব্যক্তিকে কীভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়, রাষ্ট্র কীভাবে শ্রদ্ধা জানায়৷ তাহলেই না নতুন প্রজন্ম দেশগ্রেমে জাগ্রত হবে! দেশের দুর্দিনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ দেশপ্রেম তো কোনো ট্যাবলেট না যে, এটা খেলে চেতনা জাগ্রত হবে৷ এটি একটি চর্চার বিষয়, গবেষণার বিষয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটি চর্চিত হতে হবে৷ কিন্তু সেই জিনিসটি হয়নি৷ 

প্রজন্ম '৭১-এর সদস্যরা আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে দাবি করেছে, যাতে ১৪ই ডিসেম্বর, যেটা শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, সেটাই যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানানো হয় সরকারের কাছে৷ আমার কথা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কেন দলে ভাগ করা হবে৷ অর্থাৎ খেতাবপ্রাপ্ত, চিকিৎসক, শিক্ষক এমন নানা ভাগ৷ মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই টুকরো টুকরো, খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরাও আজ বহু ভাগে বিভক্ত৷ অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন – সেই জিনিসটি কি হয়েছে? হয়নি৷

আজকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু কাজ হয়েছে৷ যেমন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে৷ একজন শহিদের সন্তান হিসেবে আমি চিৎকার করে কেঁদেছি৷

আমার কথা হচ্ছে, যাদের শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আপনারা ‘গ্লোরিফাই' করছেন, তাহলে বাকিরা কী? বাকিরা কি শহিদ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছিল? তাহলে তাঁদের কেন আলাদা করা হলো? তাঁদের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? যাঁরা গাজী হয়ে বেঁচে থাকলেন, তাঁদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করা হয়েছে৷

কিন্তু দেখেন, রাজাকারদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই৷ আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ১২০০ মাইল দূরে পাকিস্তানে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব তুলেছে৷ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ অর্থাৎ ৪৬ বছর পরও তাদের দোসর, তাদের বন্ধু, যারা ৫৬ হাজার বর্গমাইলে বাংলাদেশিদের হত্যা করার জন্য সহযোগিতা করেছে, তাদেরকে তারা ভোলেনি৷

আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমার এটাই প্রশ্ন: রাজাকারের বিচার হচ্ছে পাকিস্তানিরা কাতরাচ্ছে, অথচ আপনারা আপনাদের কোলাবরেটরদের ভুলে গেছেন, আপনাদের সহযোগীদের ভুলে গেছেন? আপনারা নিজেদের জন্য চিন্তা করেছেন, নিজেদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য চিন্তা করেছেন৷ তিন প্রজন্ম ধরে আপনারা আপনাদের জন্যই ভেবেছেন৷ কিন্তু সেই যে ৩০ লক্ষ মানুষ, যাঁদের পরিবারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, ঘুমাতে দিয়েছে,তথ্য আদান-প্রদান করেছে, সেবা দিয়েছে – এ সব কারণে আপনাদের চলে যাওয়ার পর ঐ বাড়িটার সবাইকে শুধু না, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, আপনাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে৷ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আপনাদের ‘কোলাবরেটর'-দের আপনারা ভুলে গেছেন৷ ৪৬ বছর ধরে রাষ্ট্র ভুলে আছে, মুক্তিযোদ্ধারা ভুলে আছে৷ মুক্তিযোদ্ধারা গ্রহণ করছেন, কোনো অসুবিধা নেই৷ কিন্তু আপনারা এই শহিদ পরিবারগুলোর কথা একবারও ভাবলেন না? এদের জন্য আপনাদের কি কিছু করণীয় নেই!

৩০ লক্ষ শহিদের কোনো মূল্যায়ন হলো না৷ মাঝে মাঝে আমার বাচ্চারা বলে, ‘‘দেশ দেশ করো, দেশ তোমাকে কী দিয়েছে? বাবা-মায়ের কবরও তো নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে বছরে একবার তুমি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে৷'' ওরা বার বার বিদেশের কথা বলে৷ আমি তখন একই কথা বলি, ‘‘আমার বাবা-মা, তিন ভাইয়ের কবর নেই সত্যি, কিন্তু তাঁদের আত্মা এদেশের আলো-বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷'' (এ সময় ডুকরে কেঁদে ওঠেন সাইদুর রহমান) আমি সেটাকে ধারণ করে বেঁচে আছি৷ আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, এই ৩০ লক্ষ মানুষের অভিশাপ থেকে এ বাংলাদেশ যতদিন মুক্ত না হবে, ততদিন এদেশে কাঙ্খিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হবে না৷ শহিদদের জাত করে, মুক্তিযোদ্ধাদের জাত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হবে না৷

রাজাকারদের মধ্যে কোনো বিভেদ নাই৷ ওরা একাট্টা৷ বিভেদ আমাদের মধ্যে, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি৷

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণেই তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল৷ এরপর ৩০ লাখ শহিদের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি৷ কিন্তু এই স্বাধীন দেশে মানুষের মধ্যে বৈষম্য কি কমেছে?

১৯৪৭ সালের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভাষাগত বৈষম্য ছিল৷ তারা আমাদের সবরকমভাবেই দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল, আমাদের নানাভাবে শোষণ করেছিল, আমাদের কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি৷ বঙ্গবন্ধু কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে এই বৈষম্যের কথাগুলোই বুঝিয়েছিলেন এবং মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছে৷ এই স্বাধীনতার পেছনে আকাঙ্খা কী ছিল? শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ হবে৷ কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, আপনি দেখুন, সেই সময় যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত মানুষ৷ তাঁরা জানতন যে, তাঁরা এই দেশের জন্য হয়ত জীবন দেবেন, কিন্তু দেশটি স্বাধীন হবে এ বিশ্বাস তাঁদের ছিল৷

Last part Saidur Rahman - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

কিন্তু বাংলাদেশের কিছু মানুষ, যাঁরা বৈষয়িক ছিলেন, হিসেবি ছিলেন, তাঁরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যাননি৷ বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে থাকে, ভিক্ষা করে, রিকশা চালায়৷ ৭১ সালে যিনি শহিদ হয়েছেন, তাঁর স্ত্রী ঝি-গিরি করে৷ কিন্তু আপনি কি শুনেছেন, এই ৪৬ বছরের বাংলাদেশে কোনো রাজাকার রিকশা চালায়? আপনি কি শুনেছেন, মুক্তিযোদ্ধার হাতে যে রাজাকারের মৃত্যু হয়েছে, তার স্ত্রী ঝি-গিরি করে? (না শোনার) কারণ একটাই, ওরা সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদেরকে পাকিস্তান বা এদের দোসররা এই ৪৬ বছর ধরে সাহায্য করেছে৷ তাই তাদের কখনো রিকশা চালাতে হয়নি৷ কিন্তু আমাদের শহিদ পরিবার বা মুক্তিযোদ্ধাদের এগুলো করতে হয়েছে৷

আপনি দেখেন একটি স্বাধীন দেশে একটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ সম্পদ থাকবে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই৷ বঙ্গবন্ধু তো এই বৈষম্য কমানোর কথা বলেই সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন৷ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব সম্পদ গুটি কয়েক পরিবার, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছে৷ এই জন্যই কি দেশটি স্বাধীন হয়েছিল? এ জন্যই ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন, আমাদের মতো সাইদুররা এতিম হয়েছিল?

পাকিস্তানের সময় যারা ভালো অবস্থায় ছিল, আজকে স্বাধীন দেশে তারা হয়ে গেছে নিঃস্ব৷ আর যারা ঐ সময় তেমন একটা কিছু ছিল না, স্বাধীন দেশে তারা হিমালয়ের চূড়ায় উঠে বসেছে৷ স্বাধীনতার আগে ব্যাংকের মালিক ছিল এই আদমজি, ইস্পাহানিরা৷ মানুষের টাকা দিয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে ফেঁপে ফুলে উঠেছিল৷ সে কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু এই ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ করেছিলেন৷ কারণ তিনি জানতেন, বাংলাদেশেও যদি ঐ একই সংস্কৃতি চালু করেন, এখানেও একইভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হবে৷ এখন কিন্তু তা-ই হয়েছে৷ একটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটা মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাবে, এজন্যই তো আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, বৈষম্যহীন সমাজ চেয়েছিলাম, একটি ন্যায়-সমাজিক বিচার সম্পন্ন দেশ চেয়েছিলাম৷ তার কোনোটা কি অর্জিত হয়েছে? বরং বৈষম্য বহুগুণ বেড়েছে৷ আমাদের পরস্পরের মধ্যেও বৈষম্য বহুগুণে বেড়েছে৷

এই বৈষম্য দূর করতে হলে এ রাষ্ট্রকে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র হতে হবে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নয়, ধনিক শ্রেণির রাষ্ট্র নয়, কিন্তু ৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা বিপক্ষের শক্তি যা-ই বলেন না কেন, কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে পরিচালনা করছেন না৷

ইস্পাহানি, আদমজি যে ২২ পরিবারের কথা বলা হয়, তাদের তাড়িয়ে আমরা এখন ২২ লক্ষ বা তার চেয়েও বেশি ধনী পরিবার সৃষ্টি করেছি৷ এত টাকা কোথা থেকে আসে? এ দেশের সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা, স্বপ্নকে ছিনতাই করে নিয়ে কিছু মানুষ তাদের টাকার পাহাড় গড়েছে, যারা ঘাপটি মেরে একাত্তরে বসেছিল, মুক্কিযুদ্ধে যোগ দেয়নি, অপেক্ষা করেছিল এই মানুষগুলো জীবন দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করবে আর তারা এ দেশের আদমজি, ইস্পাহানি হবে এবং তারা তাই হয়েছে৷

‘মুক্তিযোদ্ধাদের জাত করে চেতনা বাস্তবায়ন হবে না’

This browser does not support the audio element.

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার জন্য নতুন প্রজন্মকে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

একটাই পরামর্শ, একাত্তরের অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধকে জানো৷ যেখানে দল-মত নির্বিশেষে শুধুমাত্র গুটিকয়েক রাজাকার বাদ দিলে বাকি ৭ কোটি মানুষ এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল৷ ১৯৭১-এর যে জনযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে কেউ কেউ অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন, কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, কেউ খাইয়েছেন, কেউ তথ্য আদান-প্রদান করেছেন৷ নানাভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তাঁরা৷ বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনন্য৷ কারণ, এর অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ এক. পৃথিবীর কোনো যুদ্ধে মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হয়নি৷ আর দুই. পৃথিবীতে এত অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়নি৷ পাকিস্তানিরা যখন বুঝে গেল যে তারা গেরিলা যুদ্ধের সাথে পারবে না, কারণ, এদের আশ্রয়দাতা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ৭ কোটি মানুষ, সুতরাং এদের আশ্রয়হীন না করলে পেরে ওঠা যাবে না৷ সেজন্য তারা গণহারে, নির্বিচারে বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে৷ আজও পাকিস্তানিরা রাজাকারদের জন্য কাঁদছে, কিন্তু ৩০ লক্ষ শহিদের জন্য কাঁদার কেউ নেই৷

ক্রিকেটে নতুন প্রজন্মের অনেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে৷ আমি এটাতে কোনো দোষ দেখি না৷ কারণ, আমি জানি এ ব্যর্থতা আমার, এই স্বাধীন রাষ্ট্রের, স্বাধীন দেশের মানুষের, দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের, যারা ঐ ছেলেটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তৈরি করেনি৷ দেশপ্রেম আসবে কোথা থেকে? সব সময় জানবেন যে, কোনো জিনিস উপর থেকে আসতে হয়৷ ওপর বলতে হচ্ছে রাষ্ট্র, ওপর বলতে হচ্ছে রাজনীতিবিদ, ওপর বলতে দেশের নীতিনির্ধারক৷ ৪৬ বছরে তারা এই জিনিসটির চর্চা করেননি৷ ৩০ লক্ষ মানুষের জন্য একটি দিবসই দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারতো৷

আমার এ জীবনে কোনো উচ্চাভিলাষ নেই৷ আমি ৪৬ বছর ধরে অতিরিক্ত জীবন নিয়ে বেঁচে আছি৷ আমি মৃত্যুর আগে অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন দেখে যেতে চাই৷ ৩০ লক্ষ শহিদের এবং তাঁদের পরিবারের সম্মান দেখতে চাই৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ