গত সোমবার জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উর্সুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন যখন পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা বা ইবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য স্বেচ্ছাসেবীর ডাক দেন, তখন অনেকের মনোভাব ছিল: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’?
বিজ্ঞাপন
এবোলা একটি ভয়ংকর মহামারী৷ পশ্চিম আফ্রিকার অবস্থাও এখন বিশৃঙ্খল৷ এই পরিস্থিতিতে সেখানে সরকারি আদেশ দিয়ে জার্মান সৈন্য পাঠানোর অর্থ, তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়লে সরকারকে তাঁদের বীমা ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত নানা আইনগত সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হতে পারে – প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়ত যা করতে চাননি৷ স্বদেশে সৈন্যদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা মহামারীর বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে বলা চলে – কিন্তু বিদেশে? বস্তুত একটি মানবিক মিশনে?
এক হিসেবে জার্মান সেনাবাহিনী ও জার্মান সমাজ তাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মান রেখেছে: ফন ডেয়ার লাইয়েন ডাক দেবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেনাবাহিনীর ৫০০ জন সদস্য জানিয়েছেন যে, তাঁরা স্বেচ্ছায় এবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রামে যেতে রাজি৷ এই স্বেচ্ছাসেবীরা ‘বুন্ডেসভের', অর্থাৎ জার্মান সেনাবাহিনীর প্রায় সব অংশ থেকে এসেছেন, বলে জানান জার্মান সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র৷
সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য হিসেবে যাঁদের ডাক পড়তে পারে, তেমন রিজার্ভ সৈন্যরা, এবং বেসামরিক ব্যক্তিরাও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়েছেন – ফন ডেয়ার লাইয়েন যাকে বলেছেন, ‘‘সাহায্যের প্রস্তুতির একটি চমৎকার নিদর্শন''৷ বিশ্ব তথা ইউরোপের অপরাপর দেশেও অনুরূপ সাহায্যের প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হয়েছে: যেমন ব্রিটেনের সরকারি স্বাস্থ্য সেবার মোট ১৬০ জন সদস্য এবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রামে যেতে প্রস্তুত৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারবর্গ ইউরোপীয় ত্রাণকর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত৷ ২৮টি ইইউ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীবর্গ ইটালির মিলানে মিলিত হয়ে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেটি হলো: এবোলার বিরুদ্ধে অভিযানে ইউরোপীয় ত্রাণকর্মীরা যদি নিজেরাই সংক্রমণের শিকার হন, তাহলে তাদের নিয়ে কী করা হবে৷ সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ত্রাণকর্মীর অকুস্থলেই চিকিৎসা করা হবে, নাকি রোগীকে বিমানযোগে স্থানান্তরিত করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া থাকা প্রয়োজন, বলে ইইউ স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের ধারণা৷ ইইউ দেশগুলির একক সরকারবর্গ বিমান, ত্রাণকর্মী ও রোগীদের জন্য বিশেষ ‘স্ট্রেচার' প্রদান করবেন, সেটিও এক সিদ্ধান্ত৷
মহামারি ইবোলা ভাইরাস
ইবোলা বা এবোলা ভাইরাসকে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এতে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চান এবোলাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অন্যতম ঘাতক জ্বর হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তপ্রদাহজনিত এই জ্বর৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/dpa
পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি
মারাত্মক এবোলা ভাইরাসের আক্রমণে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭১১৷ গিনিতে গত মার্চে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এবোলা ভাইরাসের প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাইবেরিয়ায় জরুরি অবস্থা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দেশ লাইবেরিয়ায় বৃহস্পতিবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে৷ এতে সরকার বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে৷ প্রাণঘাতী এবোলা ভাইরাস এখন আফ্রিকা থেকে বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আক্রান্ত অন্যান্য দেশের নাগরিক
স্পেনের একজন প্রবীণ ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক মারাত্মক অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গেছেন৷ তিনি এবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সৌদি আরবে একজন রোগীর মৃত্যুর কারণও এবোলা বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা৷ নাইজেরিয়াতেও একজন নার্স এবোলার সংক্রমণে মারা গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবোলা সংক্রমণের লক্ষণ
এবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক জ্বর এবং কারও কারও অবিরত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে৷ সঙ্গে থাকে মাথা, পেশী এবং তলপেটে তীব্র ব্যথা৷ রোগীর একদিকে ক্ষুধা কমে যায়, অন্যদিকে শুরু হয় পাতলা পায়খানা৷ সাধারণত শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল পদার্থের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রান্ত চিকিৎসক
বলা বাহুল্য, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যাকারীর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ লাইবেরিয়াতে যেমন এবোলা রোগীদের পরিচর্যাকারী দুই মার্কিন স্বাস্থ্যকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর, তাঁদের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংক্রমণের আশঙ্কা
মূলত কোনো প্রাণী বা মানুষের রক্ত, বীর্য, যোনিরস বা দেহ নির্গত অন্য কোনো তরলের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ বলা বাহুল্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিরাপদ যৌন মিলনেও এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইডস রোগের সঙ্গে এবোলার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল৷ এই প্রাণীটি ভাইরাসটি বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ এমনকি সংক্রমিত প্রাণীটি যখন ফলমূল ও অন্যান্য প্রাণী খাচ্ছে, তখন সেসব খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ থেকেও ছড়িয়ে পড়ছে এবোলা৷
ছবি: imago
সংক্রমণের ঝুঁকি
তার মানে শুধু মানুষ থেকে মানুষে নয়, মানুষ যখন এবোলায় আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত বা মাংসের সংস্পর্শে আসে, তখনও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ বরং সেক্ষেত্রে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তাই খ্যাঁকশিয়াল থেকে অন্য প্রাণী বা ফলমূল হয়ে সহজেই মানুষের মধ্যে এবোলা ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি করে৷
ছবি: DW
৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু
এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ সেজন্যই তো একে মহামারি বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Reuters
বড় সমস্যা
বলা বাহুল্য, আফ্রিকায় বন্য প্রাণী খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে৷ সব বাজারেই এ সব মাংস পাওয়া যায়৷ গবেষকদের ধারণা, এ ধরনের বন্য প্রাণীর মাংস থেকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবোলা৷ তার সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলন তো রয়েছেই!
ছবি: picture-alliance/dpa
পরীক্ষামূলক ওষুধ এখনই নয়
এবোলা সংক্রমণ নিরাময়ের উপায় এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার সময় এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ কারণ মার্কিন দুই স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগে তাঁদের উন্নতির ধরণে তারতম্য দেখা গেছে৷
ছবি: LEON NEAL/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের প্রতি জরুরি সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন৷ লাইবেরিয়াতেই এবোলার প্রকোপ সর্বাধিক, বলে সারলিফ জানান: সংক্রমিতদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি; অর্ধেকের বেশি রোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে৷ জাতিসংগের এক উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি লাইবেরিয়া সফর করার পর জানিয়েছেন যে, সেখানে জরুরি ভিত্তিতে অন্তত ৭০০ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন৷ বর্তমানে সেখানে বড়জোর শ'দেড়েক বিদেশি চিকিৎসক, পরিচারক ও নার্স কাজ করছেন৷ রোগীদের আলাদা রাখার জন্য মাত্র ৪০০টি ‘বেড' রয়েছে, অথচ প্রয়োজন দুই হাজার ‘বেডের'৷