৫০ বছরে নকশালবাড়ি আন্দোলন
২৫ মে ২০১৭ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান বিচার করলে দেখা যাবে, সংসদীয় পথে সক্রিয় বামপন্থিরা এখন মাত্র দু'টি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে– কেরালা ও ত্রিপুরা৷ এছাড়া বিরোধী শক্তি হিসেবে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বামপন্থিদের ক্ষমতা বলার মতো৷ এই বামেরা যখন ক্রমশ জমি হারাচ্ছে, অন্যদিকে জঙ্গলমহলে সক্রিয় হচ্ছে সশস্ত্র বামেরা, সে সময় প্রশ্ন উঠছে– তাহলে কি নকশালবাড়ির রাস্তাই ঠিক ছিল? ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়সহ বিভিন্ন রাজ্যে ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে নকশালপন্থি বা মাওবাদীরা৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলেছেন, নকশালপন্থাই দেশের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি৷ তাঁদের স্বীকারোক্তিতেই প্রমাণিত হয়, ভারত সরকার সংসদীয় পথে রাজনীতি করা বামেদের তুলনায় সংসদের বাইরে সংগ্রামরত বামেদের নিয়ে বেশি চিন্তিত৷
এই বিতর্কে ঢোকার আগে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে তার ইতিহাসে একবার নজর দেওয়া দরকার৷ সিপিআইএম বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ভেঙে তৈরি হয় সিপিআই (এমএল) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)৷ এই দলের নেতা চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের বক্তব্য ছিল, স্বাধীনতার পর দু দশক ধরে সংসদীয় রাজনীতি কমিউনিস্টদের বিপ্লবী চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে৷ তাই সংসদীয় রাজনীতিতে থাকলে সর্বহারা মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়৷
১৯৬৭ সালে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামে হিংসাত্মক আন্দোলনের প্রথম স্ফূলিঙ্গ দেখা যায়৷ সেই গ্রামে কৃষকরা আইন হাতে তুলে নেন৷ ভূস্বামীদের উৎখাত করে জমির ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন৷ চারু মজুমদার চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং-এর মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন৷ তিনি মনে করতেন, শ্রমিক-কৃষকের যা প্রাপ্য, তা আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়৷ এ জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে৷ এই নকশালপন্থিদের চোখে ভূস্বামী কিংবা শিল্পপতিরা শোষক শ্রেণি, খেটে খাওয়া মানুষ শোষিত৷ তাই চারু মজুমদার নীতি, শ্রেণিশত্রুদের খতম করতে হবে৷ এই রক্তপাতের মাধ্যমেই একদিন বিপ্লব সম্পন্ন হবে, শাসন ক্ষমতা আসবে খেটে খাওয়া মানুষের হাতে৷
১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন ভারতে এখনও টিকে রয়েছে৷ নকশালপন্থি আন্দোলন মতাদর্শগত সংঘাতের জেরে বহু ধারায় বিভক্ত হয়েছে, রাষ্ট্রশক্তি তার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে, তবু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধিকিধিকি জ্বলছে সশস্ত্র বামপন্থার আগুন৷ ছত্তিশগড়ে সম্প্রতি একাধিক হামলায় মাওবাদীরা আধাসামরিক বাহিনীকে নিশানা করেছে, মেরে ফেলেছে জওয়ানদের৷ সে কারণেই নকশালপন্থি, আজ যাদের পোশাকি নাম মাওবাদী, তারাই ভারত সরকারের মাথাব্যথার কারণ৷
প্রায় তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে৷ পতন হয়েছে পূর্ব ইউরোপের৷ বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে নির্বাচন ও গণতন্ত্র এখন বহুল স্বীকৃত, এর কোনও বিকল্পও নেই৷ বন্দুকের নলের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখল করার বদলে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের রীতিই জনপ্রিয় হয়েছে দেশ দেশে৷ চীনে কমিউনিজমের পতাকা থাকলেও তারাও বাজার অর্থনীতির রাস্তায় চলেছে৷ একই অবস্থা ভিয়েতনাম বা কিউবার মতো কমিউনিস্ট দেশগুলির৷ গত শতাব্দীর ৭০ কিংবা ৮০-র দশকে, যখন কমিউনিস্ট সোভিয়েতের অস্তিত্ব ছিল, তখন নকশালপন্থি আন্দোলন বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল৷ কিন্তু, সোভিয়েতের পতনের ফলে বহুকালই সেই পরিস্থিতি আর নেই৷ ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ বলে আন্দোলনকে সাধুবাদ জানানোর জন্য বিশ্ব নেতৃত্ব অনুপস্থিত৷ তা সত্ত্বেও কোন জাদুবলে আজও ভারতে চরম বামপন্থি আন্দোলন টিকে রয়েছে, সেই প্রশ্ন নকশালবাড়ির ৫০ বছরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে৷
প্রাক্তন বামপন্থি নেতা ও তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর বক্তব্য, ‘‘মানুষ যেদিন থেকে এটা বুঝেছে, ভোটের মাধ্যমে অপছন্দের শাসককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব, সেদিনই সশস্ত্র আন্দোলন তার গুরুত্ব হারিয়েছে৷ তাই মানুষের এখন আস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি৷’’ সংসদীয় পথে যাঁরা এখন লাল পতাকা নিয়ে আন্দোলন করেন, তাঁদের বামপন্থি বলে মানতে রাজি নন মন্ত্রী৷ এই বামপন্থিদলগুলোকে খারিজ করলেও বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেননি তিনি৷ পূর্ণেন্দু বসুর মন্তব্য, ‘‘যতদিন পৃথিবীতে শোষণ-নিপীড়ন থাকবে, ততদিন বিদ্রোহ-বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ফুরোবে না৷’’
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট আমলের শেষ পর্যায়ে জঙ্গলমহলের তিন জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় মাওবাদী তৎপরতা ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল৷ ২০১০ সালের আগে ও পরে বহু বামপন্থি নেতা-কর্মী সশস্ত্র বামেদের হাতে খুন হয়েছেন৷ শিলদাসহ বিভিন্ন জায়গায় আধাসামরিক বাহিনী আক্রমণের মুখে পড়েছে৷ ২০১১-য় রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি বদলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বহুদিন মাওবাদী তৎপরতার খবর নেই, অনেক নেতা-নেত্রী সরকারের প্রস্তাবে সায় দিয়ে মূলস্রোতে মিশে গিয়েছেন৷
নকশালপন্থিদের দু'টি গোষ্ঠী পিপলস ওয়ার গ্রুপ ও মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার (এমসিসি) মিলে তৈরি করেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)৷ এরা এখনও বিভিন্ন রাজ্যে সক্রিয় হলেও এই সংগ্রাম নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে বলে মত প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমল মুখোপাধ্যায়ের৷ তিনি বলেন, ‘‘সংসদের বাইরে এ ধরণের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন আদতে সন্ত্রাসবাদে পরিণত হয়৷ মানুষ খুনের রাজনীতি সফল হতে পারে না৷ পাঁচ দশক আগে মতাদর্শের যে শক্তি ছিল, আজ আর নেই৷’’ এ কথা বললেও ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূত্রপাতকে ঐতিহাসিক বলেই মনে করেন তিনি৷ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে প্রবীণ অধ্যাপক বলেন, ‘‘চারু মজুমদার গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার যে ডাক দিয়েছিলেন, সে সময়ের নিরিখে তার তাৎপর্য ছিল৷ কিন্তু, ক্রমশ এই আন্দোলন বিপথগামী হয়ে যায়৷ প্রেসিডেন্সি কলেজ চরমপন্থি আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল৷ তাই নকশালবাড়ির উত্থান ও পতন আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে৷ এই আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে আমার বহু উজ্জ্বল ছাত্র হারিয়ে গেছে৷ যাদের মোহভঙ্গ হয়েছে, তারা এখন বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে৷’’
সিপিএম নেতা ও পূ্র্বতন বাম সরকারের মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায়ের মতে, পাঁচ দশক আগের নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে আজকের মাওবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের সম্পর্ক নেই৷ অর্থাৎ, শুধু নামেই তারা উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে৷ মানব মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘অতীতের নকশালপন্থিরা এখন বৃহত্তর বাম আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছেন৷ তাই সেই অর্থে নকশালবাড়ির অনুসরণে সশস্ত্র সংগ্রাম বলে কিছু নেই৷ তবে, মানুষ যদি মনে করে গতানুগতিক রাজনৈতিক পথে তাদের দাবি পূরণ হচ্ছে না, তাহলে আজও তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে৷ নেতৃত্ব সবসময় আন্দোলনের পথনির্দেশ দেবে, এটা ঠিক নয়৷ নিপীড়িত মানুষই প্রয়োজন অনুসারে রাজনৈতিক কর্মসূচি বেছে নিতে পারে৷ কিন্তু তাই বলে সশস্ত্র আন্দোলন করে সরকার বদলে দেব, এটা রাজনৈতিক পথ হতে পারে না৷’’