তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সব মামলাকে ছাপিয়ে গেছে খুলনার ডুমুরিয়ার একটি মামলা৷ প্রতিমন্ত্রীর বিতরণ করা ছাগলের মৃত্যুতে স্ট্যাটাস দেওয়ায় গ্রেপ্তার হয়ে একদিন হাজতবাসে ছিলেন এক সাংবাদিক৷ বুধবার তিনি জামিন পেয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
২৯ জুলাই ডুমুরিয়ায় এফসিডিআই প্রকল্পের আওতায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কিছু পরিবারের মধ্যে হাঁস, মুরগি ও ছাগল বিতরণ করে৷ ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ৷ রাতেই বিতরণ করা একটি ছাগল মারা যায়৷ এরপর স্থানীয় দৈনিক প্রবাহের ডুমুরিয়া প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ মোড়ল ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে বিতরণ করা ছাগলের রাতে মৃত্যু’ শিরোনামে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন৷
প্রতিমন্ত্রী বা তার দলের কেউ এতে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও ক্ষুব্ধ হন আরেক সাংবাদিক৷ স্পন্দন পত্রিকার ডুমুরিয়া প্রতিনিধি সুব্রত ফৌজদার তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন ৩১ জুলাই৷ মঙ্গলবার এই মামলায় লতিফ মোড়লকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ তবে বুধবার তিনি জামিন পান৷
মামলার বাদি সুব্রত ফৌজদার ডয়চে ভেলের কাছে অভিযোগ করেন, ‘‘ছাগল মরে গেছে এটা কোনো বিষয় নয়৷ বিষয় হলো ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্ত্রীর ছবি দিয়েছে৷ পরে ব্রেকিং নিউজও দেয়৷ সেখানে মৃত ছাগল, ছাগলের মালিকের ছবি দেয়া যেত৷ তা না করে মন্ত্রীর ছবি দিয়ে তাকে হেয় করা হয়েছে৷ যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে৷ কারণ মন্ত্রী এলাকার উন্নয়নে অনেক কাজ করছেন৷ তা তাদের চোখে পড়ে না৷ তারা সব কিছুইতেই নেগেটিভ দেখে৷’’
‘বিষয় হল ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্ত্রীর ছবি দিয়েছে’
তবে সাংবাদিক হয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করায় পরে তার খারাপ লেগেছে বলেও জানান সুব্রত৷
তাঁরদাবি, ‘‘আমার সাথে ওই সাংবাদিকের ব্যক্তিগত কেনো শত্রুতা নাই৷ মন্ত্রীর অপমান হয়েছে বলেই মামলা করেছি৷ মামলার আগে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, তোমরা যা ভালো মনে কর কর৷ তিনি আমাকে সরাসরি মামলা করতে বলেননি৷’’
তবে এই ফেসবুক স্ট্যাটাস বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানালেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ৷ তাঁর সাথে কথা বলেই মামলা হয়েছে, এমন তথ্যও ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি ডুমুরিয়ায় ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলাম৷ পুরো সময় ছিলাম না, টোকেন হিসেবে একটি ছাগল বিতরণও করেছি৷ তবে যে ছাগলটি বিতরণ করেছি সেই ছাগলটি মরে নাই৷ অন্য একটি ছাগল মরেছে৷’’
ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে তাঁর মানহানি হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি স্ট্যাটাসটি দেখিনি৷ খবরটিও দেখিনি৷ তাই আমার মানহানি হয়েছে কি হয় নাই তা বলতে পারবনা৷ যে ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছে তাকে জিজ্ঞেস করেন৷’’
‘আমার মানহানি হয়েছে, কি হয় নাই তা বলতে পারবনা’
‘বাদি আপনার সঙ্গে কথা বলার পর মামলা করেছেন’ – এর জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার সাথে কথা বলে তিনি মামলা করেননি৷ আমার সাথে এ নিয়ে তার কোনো কথা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷’’
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এটি ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ৷ তুচ্ছ কিছু ঘটলো আর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হলো – এটি ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ৷ এ ধারা বাতিলের চেয়ে এর অপপ্রয়োগ বন্ধ করা দরকার৷’’ এ জন্য তথ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫৭ ধারা করা হয়েছিল৷ কিন্তু তুচ্ছ কারণে এর অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে৷ খুলনায় যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক৷’’
এদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ গণমাধ্যমেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে এই মামলাকে৷ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও এর প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে৷
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে ৩৯১টি৷ এ সব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭৮৫ জনকে, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩১৩ জন৷ এ সব মামলায় অধিকাংশই ৫৭ ধারায়৷ শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই ৫৭ ধারায় ছয় মাসে মামলা হয়েছে ১৯টি৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’