বাংলাদেশে সুন্দরবনের কাছে রামপালে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র বায়ু দূষণের পরিমাণ ভয়ংকরভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে এবং ৬,০০০ মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে৷ আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন গ্রিনপিস জানিয়েছে এই তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের কাছে রামপালে ১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশের অ্যাক্টিভিস্টরা এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন মনে করে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জীববৈচিত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং সাধারণ মানুষের শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার ভারতের সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর৷
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করে জাতিসংঘ সম্প্রতি বাংলাদেশকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছে৷ বিশ্ব সংস্থাটি মনে করে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের জন্য অগ্রহণযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করছে৷ ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় দেয়াল হিসেবে কাজ করে এই বন৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
এদিকে, নতুন এক প্রতিবেদনে গ্রিনপিস জানিয়েছে যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যে বায়ু দূষণ ঘটাবে তা বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েক মিলিয়ন মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কার্যক্রম পরিচালনার মেয়াদকালে যে নিঃসরণ ঘটবে তাতে প্রাপ্তবয়স্কদের স্ট্রোক, ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট এবং শ্বাসযন্ত্রে নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ার পাশাপাশি শিশুদেরও শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ দেখা দেবে৷’’
এমনকি ঢাকা এবং কলকাতায় বসবাসরত মানুষরাও, বিশেষ করে, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বায়ু দুষণের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছে গ্রিনপিস৷ এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশে বায়ু দূষণের পরিমাণ যদি এখন শূণ্যও হয়, তাহলেও শুধুমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কারণে ৬,০০০ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটবে এবং ২৪,০০০ কম ওজনের শিশুর জন্ম হবে৷’’
এছাড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে নির্গত মারকারির কারণে কেন্দ্রের আশেপাশের, এমনকি বঙ্গোপসাগরের মাছও খাওয়ার অনুপোযোগী হয়ে যেতে পারে, যা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে থাকা কয়েক লাখ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে গ্রিনপিসের প্রতিবেদনে৷
উল্লেখ্য, ভারতের সহায়তায় ১ দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি নিয়ে বিপুল সমালোচনা হলেও তা আমলে নিতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তিনি মনে করেন, পরিবেশের ক্ষতির দিকটা নিয়ে প্রকল্পের যে বিরোধিতা করা হচ্ছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ তবে গ্রিনপিসের সর্বশেষ প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বা প্রকল্প পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷
এআই/এসিবি (এএফপি)
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...