চলচ্চিত্রে সংকট চলছে? প্রশ্নটি এত অবান্তর যে, ফেরদৌসের সঙ্গে কথা শুরুই করতে হলো চলচ্চিত্রে সুদিন ফেরানোর উপায় জানতে চেয়ে৷ আলোচনা শুরুর পর ডয়চে ভেলেকে চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন ঢাকা এবং কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা৷
বিজ্ঞাপন
১৯৯৮ সাল৷ দেশের চলচ্চিত্রে তখনো দুর্দিন৷ ঢালিউডে ‘ভালো ছবি'র আকালকে আরো প্রকট করে তুলেছে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি৷ মুম্বই ছবির সফল নির্মাতা বাসু চ্যাটার্জি তখনই নিয়ে এলেন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি'৷ ভারতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া একটি তামিল ছবির রোমান্টিক গল্প, নচিকেতা চক্রবর্তীর সংগীত পরিচালনায় চমৎকার কিছু গান এবং সর্বোপরি দু' দেশের এক ঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রীর সুঅভিনয়কে সার্থক করে তোলা ঝকঝকে রঙিন প্রিন্ট – সব মিলিয়ে ছবি সুপার-ডুপার হিট৷ শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, মনোজ মিত্র, শ্রীলেখা মিত্রসহ দু' দেশের বেশ কয়েকজন সুপরিচিত, স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী৷ তবে বড় চমক ছিল দুই আনকোরা মুখ – বাংলাদেশের ফেরদৌস ও ভারতের প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী৷
Interview with Ferdous - MP3-Stereo
কিছুদিনের জন্য বাংলা চলচ্চিত্রে সুবাতাস নিয়ে এসেছিল হঠাৎ বৃষ্টি৷ কিন্তু সেই সুবাতাস একেবারেই স্থায়ী হয়নি৷ তবে ‘হঠাৎ বৃষ্টি' নিয়ে হঠাৎ এলেও নায়ক ফেরদৌস এখনো হারিয়ে যাননি৷ ১৯ বছর পরও দুই বাংলায় জনপ্রিয় তিনি৷
টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘হঠাৎ বৃষ্টি'-র প্রায় দু' দশক পর কলকাতার চলচ্চিত্র কিন্তু দুঃসময় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কেন এখনো সেই তিমিরেই পড়ে আছে? ফেরদৌস প্রথমেই বললেন বাজেটের কথা৷ ‘‘৯৮-এ হঠাৎ বৃষ্টি'র সময় একটা ছবির বাজেট ছিল ৮/১০ লাখ, এখন কলকাতায় ছবি হয় ৮/১০ কোটি টাকার বাজেটে৷'' ফেরদৌসের মতে, ঢাকাই ছবিতে এখন খুব কম প্রযোজকই এত টাকা লগ্নি করতে রাজি৷
বড় বাজেটের ছবি হয় না কেন? ফেরদৌসের অনেক কথার সারকথা একটাই – ‘‘ ভালো ছবির আকাল৷''
বাংলা চলচ্চিত্রের এ কী দশা
চলছে বাংলা চলচ্চিত্রের চরম দুঃসময়৷ মানসম্পন্ন সিনেমার অভাবে দর্শকরা যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে৷ দর্শকের অভাবে বহু সিনেমা হল বন্ধ৷ আর যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও চলছে ধুকে ধুকে৷ ছবিঘরে থাকছে সেই গল্পই৷
ছবি: Getty Images
এখনো আছে মধুমিতা
ঢাকার প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো সিনেমা হল ‘মধুমিতা’ টিকে আছে এখনো৷ প্রায় ৬০ বছর আগে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছিল৷ মাঝে অনেকটা সোনালি সময় পার করেছে এই চলচ্চিত্র৷ কিন্তু পাঁচ যুগ পরে এসে এখন তা অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বিপর্যয়
১৯৯৯ সাল থেকে এ দেশে ব্যাপক হারে অশ্লীলতানির্ভর নিম্নমানের ছবি নির্মাণ শুরু হয়৷ সাধারণ দর্শক তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেরকম ছবি দেখার কথা ভাবতেই পারেনি৷ এছাড়া সিনেমা হলে মৌলবাদীদের হামলার ঘটনাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বিপর্যয়ের আরেক কারণ৷
ছবি: Getty Images
এক হলে ১৩ জন দর্শক!
হাটখোলা এলাকায় ঢাকার আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ‘অভিসার’৷ এ ছবি তোলার সময় সেখানে প্রদর্শনী চলছিল প্রায় এক হাজার আসনের এ সিনেমা হলে এ প্রদর্শনীতে সর্বমোট দর্শক সংখ্যা ছিলেন মাত্র ১৩ জন৷
ছবি: DW/M. Mamun
দুরবস্থার কারণ
২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার অভিসার সিনেমা হল পরিচালনায় যুক্ত কবির হোসেন৷ চলচ্চিত্রের এ দুর্দশার জন্য তিনি সিনেমার মান আর বিভিন্ন সহজলভ্য স্যাটেলাইট টেলিভিশনকেই দায়ী করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভালো ছবির কদর
ঢাকার আরেকটি সিনেমা হলের পরিচালক মতিন মিয়া৷ ঢাকার ‘গীত সঙ্গীত’ সিনেমা হল পরিচালনা করছেন তিনি গত প্রায় আঠারো বছর ধরে৷ তাঁর মতে ভালো নির্মাতা, নায়ক-নায়িকার অভাবই চলচ্চিত্রের দুর্দশার মূল কারণ৷ কেননা, এখনো দু-একটি ভালো সিনেমা এলে হল ভর্তি দর্শক দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ব্যবসা কোথায়?
ছবিটি ঢাকার ‘গীত’ সিনেমা হলের৷ প্রায় দর্শকশূন্য হল৷ প্রায় ১১০০ আসনের এ হলে সেদিন দর্শক ছিল মাত্র ৩৪ জন৷ হলমালিকরা এ পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করেন৷ তাঁদের প্রশ্ন – এমন চলতে থাকলে ব্যবসা চালানো কিভাবে সম্ভব?
ছবি: DW/M. Mamun
দুর্দশার আরেকটি চিত্র
ঢাকার আরেক সিনেমা হল ‘সঙ্গীত’-এরও একই অবস্থা৷ এ হলেও প্রায় সব আসন ফাঁকা রেখে শো চালানো প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বন্ধ হলো ‘গীত’ ও ‘সঙ্গীত’
ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকায় ‘গীত’ ও ‘সঙ্গীত’ সিনেমা হল৷ গত প্রায় দশ বছর ধরে ধুকে ধুকে চলার পর এ বছর রোজার আগেই বন্ধ করা হচ্ছে হল দুটি৷ এক সময় সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২০০ টি৷ বন্ধ হতে হতে এখন সারা দেশে সিনেমা হল টিকে আছে ২০০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
সিনেমা হলের জায়গায় মার্কেট কমপ্লেক্স
বাংলাদেশে সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক শুরু হয় মূলত ২০০১ সাল থেকে৷ ঢাকার ‘গুলিস্তান’ ও ‘নাজ’ সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করা হয় মার্কেট কমপ্লেক্স৷ একইভাবে পুরনো ঢাকার ‘মুন’ ও ‘স্টার’ সিনেমা হল ভেঙেও করা হয়েছে বিশাল মার্কেট৷ এভাবে পুরনো ঢাকার ‘শাবিস্তান’, পোস্তগোলার ‘পদ্মা’, ‘মেঘনা’, ‘যমুনা’ ইত্যাদি সিনেমা হলও একে একে বন্ধ হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
হল ভেঙে নতুন হল
ঢাকার ‘শ্যামলী’ সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হলেও সেখানে আধুনিক একটি সিনেমা হল রাখা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
দর্শক অশ্লীলতাবিমুখ
ঢাকার মিরপুরের ‘সনি’ সিনেমা হলে ৩২ বছর ধরে কাজ করছেন সামাদ মিয়া৷ তাঁর হলে একসময় অনেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে আসতেন৷ কিন্তু এখন আর সে দৃশ্য তিনি দেখেন না৷ সেজন্য সিনেমার অশ্লীলতাকে দায়ী করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
টিকে থাকার কৌশল
ঢাকায় যে ক’টি হল টিকে আছে, তার মধ্যে মিরপুরের ‘সনি’ সিনেমা হল একটি৷ দীর্ঘ দিন লোকসান দিয়ে হলটি টিকিয়ে রেখেছেন এক সময়ের চলচ্চিত্র পরিচালক মোহামম্দ হোসেন৷ এই কমপ্লেক্সে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকায় লোকসান দিয়েও চালানো সম্ভব হচ্ছে হলটির কার্যক্রম৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় হল কমে প্রায় অর্ধেক
ঢাকার দারুসসালাম এলাকায় আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ‘এশিয়া’৷ গাবতলী বাস স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় এ সিনেমা হলটির দর্শক ঢাকার অন্যান্য হলের তুলনায় কিছুটা বেশি৷ আশির দশকে ঢাকা শহরে ছিল ৪৪টি সিনেমা হল৷ বর্তমানে কমতে কমতে সংখ্যাটি পঁচিশেরও নীচে নেমে এসেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাধারণ দর্শক যা মনে করেন
ঢাকার সাধারণ হলগুলোতে নিয়মিত সিনেমা দেখেন রুবেল৷ তাঁর মতে, আগে সিনেমাগুলো অনেক কাহিনিনির্ভর ছিল, কিন্তু বর্তমানের সিনেমাগুলোর কাহিনি থেকে শুরু করে নির্মাণ কৌশল সবকিছুই খারাপ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরোক্ষে মৌলবাদ
অনেকেই মনে করেন, বাংলা চলচ্চিত্র থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অন্যতম কারণ অশ্লীলতা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অপর্যাপ্ত আধুনিকায়ন
চলচ্চিত্রে সংকটময় এই পরিস্থিতির জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা৷ চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযুক্তির ব্যবহারও খুব বেশি বাড়েনি৷ বিগত বছরগুলোতে বিএফডিসির কোনো আধুনিকায়নই হয়নি৷ সাভারের কবিরপুরে ফিল্ম সিটি গড়ে তোলার জন্য ১০৫ একর জমি বরাদ্দ হলেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পর্নো ছবি
ঢাকার কিছু সিনেমা হলে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে বিদেশি সিনেমা৷ ‘এক টিকেটে ২ ছবি’-র এসব প্রদর্শনীতে মূলত দেখানো হয় পর্নো সিনেমা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাল্টিপ্লেক্সই ভরসা?
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন সিনেমা হল বন্ধের মহোৎসব চলছে, সে সময়ে কিছুটা হলেও দর্শক নিয়ে আসছে ঢাকার মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলগুলো৷ সংখ্যায় খুবই কম হলেও ভালো পরিবেশের কারণে এসব মাল্টিপ্লেক্স হলে দর্শকরা আসছেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাল্টিপ্লেক্সে বেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র
বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রতিদিনই দর্শকরা ভিড় জমান বিভিন্ন সিনেমা দেখতে। তবে এসব সিনেমা হলে প্রদর্শিত সিনেমার অধিকাংশই বিদেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবারের সবার বিনোদনের স্থান
ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে স্টার সিনেপ্লেক্স মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলের একটি৷ পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে দর্শকরা আসেন সিনেমা দেখতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
20 ছবি1 | 20
ভালো ভালো ছবি নির্মিত হলে এবং সেসব ছবি ভালো পরিবেশে দেখার সুব্যবস্থা করা গেলে দর্শক যে আবার হলমুখী হবে সে বিষয়ে নায়ক ফেরদৌসের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়কে পেছনে ফেলার শর্ত হিসেবে তাই তাঁর মুখে উঠে এসেছে ৬৪টা জেলাতে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের দাবি৷
কিন্তুসিনেপ্লেক্সে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগের আর্থিক সামর্থ্য কি সমাজের খুব বেশি মানুষের আছে? চারবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারজয়ী অভিনেতা জানালেন, কয়েকদিন আগে মুম্বই ছবি ‘বাহুবলী' দেখতে ঢাকা থেকে কয়েকশ' মানুষ প্লেনের টিকিট কেটে ভারতে গেছে৷ নিজে এমনটি হতে দেখেছেন বলে ফেরদৌসের ধারণা, বিনোদনের জন্য পয়সা খরচ করতে প্রস্তুত মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে৷
কিন্তু তাদের কথা মাথায় রেখে সিনেপ্লেক্স বানালেই বা কী লাভ! সিনেপ্লেক্সগুলোতে তো বিদেশি ছবিই বেশি চলে! ফলে সিনেপ্লেক্স হলেই দেশি ছবির সুদিন ফিরবে এমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারে? এক্ষেত্রে ফেরদৌস স্মরণ করালেন কলকাতার দৃষ্টান্ত, বললেন, ‘‘ কলকাতায় যখন সিনেপ্লেক্স হলো, তখন বাংলা সিনেমা সেখানে দেখানো হয়নি৷ এখন প্রথমেই বাংলা সিনেমা দেখায়৷ সুতরাং...''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷