১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ ৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ৷ ৪৭ বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি৷
বিজ্ঞাপন
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে৷ গবেষণা হয়েছে৷ পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে৷ গত বছরের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো৷ গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা৷ যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী৷ এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে৷ ফলে এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়েছে৷ আর একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে স্বল্প সময়ে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন , সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন৷ তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন৷ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলেছেন৷ সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পেরেছেন৷ তাঁরা যা চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তা-ই তাঁদের কাছে তুলে ধরেছেন৷ ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়৷ এই ভাষণই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়েছে৷ আর এতবছর পরও মানুষ তাঁর ভাষণ তন্ময় হয়ে শোনেন৷
১৯৭১ সালের এই দিনে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শোনান৷ এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷'' তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআলাহ!''
‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো’
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে৷ আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে৷ তিনি তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতার শেষাংশে লিখেছেন, ‘‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'৷''
কবি নির্মলেন্দু গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে৷ এরমধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ বলতে পারে৷ অন্য কোনো ভাষণ এভাবে স্কুল- কলেজের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মুখস্থ বলতে পারে বলে আমার জানা নাই৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু আমিই যে বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছি, তা কিন্তু নয়৷ পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স'৷ তাঁর ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাঁকে পোয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তাঁর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো৷''
নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘‘একজন কবি মানুষের মনের কথা বললেন কিনা তা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ তিনি কিভাবে বলেন, কোন ঢংয়ে বলেন, তা অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ৷ মাইকেল মধুসূদন দত্ত'র মেঘনাধবধ কাব্য মানুষের মনের কথা নয়, তবে বলার ঢংয়ে তা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে৷ আর বঙ্গবন্ধু'র ভাষণে তাঁর নাটকীয়তা এবং সম্মোহনী কথা বলার স্টাইল ছাড়াও যুক্ত হয়েছে মানুষের মনের কথা বলার বিষয়টি৷ তিনি ৭ মার্চের বক্তৃতায় মানুষের মনের কথা বলেছেন৷ আশার কথা বলেছেন৷ আর সে কারণে এখনো তাঁর সেই বক্তৃতা মানুষকে উজ্জীবিত করে৷ পৃথিবীর কোনো নেতা ১০ লাখ মানুষের মাঝে এরকম উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই৷ আজো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তাঁর ভাষণ বেঁচে আছে৷ থাকবে৷ তাই এটা অমর কবিতা৷ আর সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷''
Harun Or Rashid - MP3-Stereo
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নানা দিক বিশ্লেষন করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ৷ তাঁর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুরর ৭ মার্চের ভাষণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর সেগুলো হলো: ১.বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, ২. গণতান্ত্রিক চেতনা, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. শান্তির বাণী, ৫. মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ৬. আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ৷
তিনি বলেন, ‘‘এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন৷ কিন্তু তা সহিংস নয়৷ তিনি শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা বলেছেন৷ অহযোগের কথা বলেছেন, আবার সবাইকে মাসের এক তারিখ গিয়ে বেতন আনতে বলেছেন৷ তাঁর এই একটি বক্তৃতা একটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছে৷ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে৷ আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম হয়নি৷ একটি ভাষণেই পুরো দিক নির্দেশনা ছিল৷ একটি ভাষণের এই অর্জন এবং গুণাবলী বিশ্বের আর কোনো ভাষণের আছে বলে আমার জানা নাই৷''
‘‘বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে৷ তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেনছেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার৷ তাই সারবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সার্বজনীন অধিকার৷''
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷''- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷ তিনি বলেছেন, এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের৷ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়৷
বিরল ছবিতে বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়৷ এসব অধ্যায় অনেকটাই ফুটে উঠেছে এই ছবিগুলোতে৷
ছবি: Journey/M. Alam
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহিদদের খবর প্রকাশিত হয় পত্রিকায়৷ ছবিটি ফটোগ্রাফার রফিকুল হকের তোলা৷
ছবি: Journey/R. Hoque
একুশের প্রভাতফেরি
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম প্রভাতফেরি৷ সেখানে নারীদের সাহসী পদচারণার ছবিটিও তুলেছেন রফিকুল হক৷
ছবি: Journey/R. Hoque
৬৬’র ছাত্র আন্দোলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলনের ছবিটি তুলেছেন আজমল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
মধুর ক্যান্টিন
মধুর ক্যান্টিন৷ বাংলাদেশের অনেক আন্দোলনের সূত্রপাতই এখান থেকে৷ ১৯৬৭ সালে ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার রশিদ আহমেদ৷
ছবি: Journey/R. Ahmed
৬৯-এর প্রভাতফেরি
১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির ছবিটি তুলেছেন এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানে বক্তব্য রাখছেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ৷ ছবিটি তুলেছেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রশীদ তালুকদার৷
ছবি: Journey/R. Talukder
বঙ্গবন্ধু’র ঐতিহাসিক উচ্চারণ
‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’’৷ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর এ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা
ছবিটি ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে তোলা৷ তীর, ধনুক হাতে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন আদিবাসীরাও৷ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
প্রতিবাদী শিল্পীরা
পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার শিল্পী সমাজ৷ ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ ছবিটি তোলেন রশীদ তালুকদার৷
ছবি: Journey/R. Talukder
পত্রিকায় ২৫শে মার্চ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল সেই তথ্য৷
ছবি: Journey
কারফিউ ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কারফিউ ভাঙার অপরাধে এক বাঙালিকে শায়েস্তা করছে পাকবাহিনী৷ ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার রশিদ আহমেদ৷
ছবি: Journey/R. Ahmed
বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ পড়ে আছে৷ ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ছবিটি তোলেন ফটোগ্রাফার এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
অস্ত্র সমর্পণ
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারির ছবি এটি৷ ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান৷ বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
মিত্র বাহিনীর বিদায়
১২ মার্চ, ১৯৭২ সাল৷ মিত্র বাহিনীর বিদায় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিত সিং অরোরা৷ ঐতিহাসিক এই ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
শহিদ মিনারের পরিবর্তে মসজিদের পরিকল্পনা
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর বিধ্বস্ত শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকসুর তৎকালীন জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন৷ পাশে মসজিদ লেখাটি দেখা যাচ্ছে৷ পাকিস্তানিরা শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে এখানে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল৷ ছবিটি তুলেছেন এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
শহিদ মিনার পুনর্নিমাণ
পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে৷ ১৯৭২ সালে শহিদ মিনার পুনর্নিমাণের ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধন
১৯৭৮ সালে ডাকসুর উদ্যোগে নির্মিত অপরাজেয় বাংলা উদ্বোধনের ছবি এটি৷ উদ্বোধন করেন দুই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা৷ ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার আজমল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে সারাদেশে তখন গণজোয়ার৷ ১৯৯০ সালের ২৮শে নভেম্বর ছবিটি তুলেছেন ইউসুফ সাদ৷
ছবি: Journey/Y. Saad
18 ছবি1 | 18
অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘‘এটা তাঁর মানবিকতা এবং অসাম্প্রদয়িক চরিত্রের প্রকাশ৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘৭ই মার্চের ভাষণের বড় শিক্ষা হলো কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না৷ বন্দুকের নল বা অস্ত্রের মুখে ‘দাবায়ে' রাখা যায় না৷ এটাই বিশ্বজনীন সত্য৷''
এদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক বাণীতে বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল আমাদের নয়, বিশ্ববাসীর জন্যই প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে৷'' তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ৷ একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ৷''
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই স্বীকৃতি৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন৷ বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র৷ কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে৷ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি৷ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ছিনিয়ে আনি মহান স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ৷ প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ৷''
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি' বইয়ে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে৷ অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ৷''
দুর্লভ ছবিতে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস
বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
এদেশের ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা৷ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করায় তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
তৎকালীন ছাত্রনেতারা
নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন এবং ওই সময়ের অন্যসব জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করতেন৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷
ছবি: Journey/R. Hoque
বঙ্গবন্ধু পথপ্রদর্শক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে কোনো রাজনীতিবিদ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক৷ বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Journey/M. Alam
ছয়দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়৷ মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের এ প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন৷
ছবি: Journey/R. Talukder
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়৷ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ পরদিন তারা পল্টন ময়দানে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়৷ শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷
ছবি: Journey/R. Talukder
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷ উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার যথার্থভাবেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয়তাবাদী অভিধাগুলি, যেমন দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷
ছবি: Journey
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো৷ গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়৷
ছবি: Journey/M. Alam
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দিয়েছে৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন হয়৷ শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা৷
ছবি: Journey/Y. Saad
২০০২ শামসুন্নাহার হল আন্দোলন
২০০২ সালের ২২ জুলাই রাত ১টায় অর্থাৎ ২৩শে জুলাই দিবাগত রাতে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর রাতের অন্ধকারে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ২৩ শে জুলাই সকাল থেকে ছাত্রদল ব্যতীত ক্যাম্পাসের ক্রীয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ ১ লা আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন ভিসি৷
ছবি: Journey/Z. Islam
২০০৭ সালে ছাত্র আন্দোলন
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক হন আট শিক্ষক, এক কর্মকর্তা৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের মুক্তি
দু’দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত কয়েকশ জন আহত হয়৷ পরে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে দণ্ড পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে ডিসেম্বরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার৷ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ছেড়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷