দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ৭০ বছর পর হত্যাকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগে জার্মানিতে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে৷ ৯৩ বছর বয়সি অভিযুক্ত নিজেকে নির্দোষ দাবি করে যুক্তি তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত বিচার এড়াতে পারেননি৷
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আউশভিৎসে কাজ করেছেন অস্কার গ্র্যোনিং৷ সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেননি৷ ট্রেন থেকে ইহুদিরা নামলে তাঁদের কাপড়চোপড়, টাকা-পয়সা গুছিয়ে রেখে দেয়াই ছিল তাঁর কাজ৷ গ্র্যোনিংয়ের দাবি, তিনি শুধু সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন৷ কাউকে নিজে হত্যা করেননি বা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে সহায়তাও করেননি৷ এ কারণে তিনি এ দাবিও করছেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে তিন লক্ষ লোকের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন৷
১৯৪৪ সালের ১৬ মে থেকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যে ৪ লক্ষ ২৫ হাজার হাঙ্গেরীয় ইহুদিকে ধরে আউশভিৎসে নিয়ে আসে নাৎসি বাহিনী৷ ট্রেনে করে ১৩৭ বারে আনা হয় তাদের৷ রেল স্টেশনের প্লাটফর্মেই কাজ করতেন অস্কার গ্র্যোনিং৷ তার বয়স তখন ২১৷ ইতিহাস বলছে, ওই সময় হাঙ্গেরি থেকে নিয়ে আসা সোয়া চার লাখ ইহুদির মধ্যে তিন লাখ জনকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হয়৷ ওই তিন লাখ মানুষের সঙ্গে আসা টাকা-পয়সা, ঘড়ি, চশমা এবং অন্যান্য জিনিস গুনে-গুছিয়ে ঠিকভাবে বার্লিনে পাঠানোর কাজটা খুব দক্ষতার সঙ্গেই করেছিলেন গ্র্যোনিং৷
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে গ্র্যোনিং ল্যুনবুর্গ নামের একটি জায়গায় নিরিবিলি জীবনযাপন শুরু করার কারণে তাঁর ‘যুদ্ধাপরাধ'-এর বিষয়টি দীর্ঘদিন অগোচরে থেকে যায়৷ তবে ২০০৫ সালে জার্মানির বেশ কিছু পত্রিকায় যুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকার কথা বেরিয়ে আসে৷ একাধিক প্রতিবেদনে তিনি স্বীকার করেন, যুদ্ধের সময় ইহুদিদের মেরে ফেলার দৃশ্য কাছ থেকে দেখেছেন, মৃত্যুপথযাত্রীদের আর্তনাদ তিনি শুনেছেন৷ তবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তখন এ কথাও বলেছিলেন, ‘‘আমি কাউকে হত্যা করিনি৷ সেখানে আমি সামান্য একজন কর্মচারি ছিলাম৷ হত্যায় সহায়তাও করিনি আমি৷ সুতরাং আমি নির্দোষ৷''
ড্রেসডেন যেদিন ধ্বংস হয়
সত্তর বছর আগে ড্রেসডেন শহরের ওপর অগ্নিবর্ষণ করে মিত্রশক্তির বোমারু বিমান৷ প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষ সেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান৷ বোমার রাত্রির পর ড্রেসডেন-কে চেনার উপায় ছিল না৷
ছবি: Getty Images/Matthias Rietschel
বোমা, ধ্বংস, লুটতরাজ
১৯৪৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২৪৫টি ল্যাংকাস্টার বোমারু বিমান ইংল্যান্ড থেকে আকাশে ওঠে৷ রাত ন’টা বেজে উনচল্লিশ মিনিটে ড্রেসডেনে সাইরেন বাজতে শুরু করে৷ মাত্র ২৩ মিনিটের ‘কার্পেট বম্বিং’ ড্রেসডেনের উপর আগুনের গালিচা বিছিয়ে দেয়৷ ব্রিটিশ বোমারু বিমান হানা দেয় দু’বার, মার্কিনি বোমারু বিমান আরো একবার৷ শহরের প্রায় ১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ড্রেসডেন ক্যাথিড্রাল ধ্বংস
সে রাত্রির বোমাবর্ষণে ড্রেসডেনের প্রখ্যাত রোমান ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভিতরের ছাদ ও খিলান ধসে পড়ে৷ গির্জাটি স্যাক্সনি অঞ্চলের বৃহত্তম গির্জাগুলির মধ্যে গণ্য৷ এই ক্যাথলিক গির্জাটি ড্রেসডেনের অপর মহান স্থাপত্য, প্রটেস্টান্ট ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি’ থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরত্বে এবং প্রায় একই সময়ে তৈরি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মার্টিন লুথার-ও রক্ষা পাননি
প্রটেস্টান্ট মতবাদের স্রষ্টা মার্টিন লুথার-এর স্মৃতিসৌধটি চার্চ অফ আওয়ার লেডি-র ঠিক সামনে৷ বোমার রাত্রিতে স্মৃতিসৌধটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ ১৮৮৫ সালে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়৷ লুথার ১৫১৬ এবং ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে ড্রেসডেনে এসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
অর্থহীন ধ্বংসলীলার প্রতীক
অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যারোক স্থাপত্যের এক আশ্চর্য নিদর্শন ছিল ড্রেসডেনের ‘ফ্রাউয়েনকিয়র্শে’ বা চার্চ অফ আওয়ার লেডি৷ ১৯৯৩ সাল অবধি তার ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকে এক নিরর্থক ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক হয়ে৷ গির্জার চূড়ার উপর যে ক্রুশচিহ্নটি ছিল, সেটিকে আবার ঠিক সেইভাবে গড়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের এক ঢালাইকর, যাঁর বাবা বোমারু বিমানের চালক হিসেবে ড্রেসডেনের বোমার রাত্রিতে উপস্থিত ছিলেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
ড্রেসডেন তার ট্রেডমার্ক ফিরে পেয়েছে
১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ফ্রাউয়েনকিয়র্শে আবার গড়ে তোলা হয়৷ খরচ পড়েছিল প্রায় ১৩ কোটি ইউরো৷ সারা বিশ্ব থেকে অনুদান আসে৷ একানব্বই মিটার উচ্চতার গির্জাটির আশপাশের ব্যারোক বসতি স্যাক্সনির রাজধানী ড্রেসডেনের নতুন কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়ায় – বিশেষ করে পর্যটকদের চোখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hiekel
ধ্বংসের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই
বহু পর্যটক ড্রেসডেনের কেন্দ্রে ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালের সামনের চত্বর দিয়ে যাবার সময় নতুন করে গড়ে তোলা পুরনো বাড়িগুলি দেখে মুগ্ধ হন৷ প্রটেস্টান্ট স্যাক্সনির রাজা আউগুস্ট ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন পোল্যান্ডের রাজা হবার জন্য৷ ক্যাথলিক গির্জাটি তৈরি হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি৷
ছবি: picture alliance/Johanna Hoelzl
নবরূপে
১৯৪৫’এর বোমার রাত্রিতে ক্ষতিগ্রস্ত লুথার মূর্তিটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৫৫ সালে৷ কিন্তু ২০০৩-৪ সাল পর্যন্ত মূর্তিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থাতেই রাখা হয়েছিল – যুদ্ধ ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে৷ মেরামত করা মূর্তিটির পাদদেশে আজকাল তরুণ-তরুণী ও পর্যটকদের ভিড় করতে দেখা যাবে৷
ছবি: imago/Chromorange
এলবে নদীর তীরের ফ্লোরেন্স
ড্রেসডেন আজ জার্মানির সবচেয়ে সুন্দর শহর বলে গণ্য হয়৷ তার ব্যারোক স্থাপত্যের জন্য ড্রেসডেন-কে বলা হয়, এলবে নদীর তীরের ফ্লোরেন্স৷ এই শহরে বহু দেখার জিনিস আছে, যা পর্যটকদের টানে৷ সাড়ে পাঁচ লাখ বাসিন্দা সম্বলিত ড্রেসডেন জার্মানির ১২টি বৃহত্তম শহরের মধ্যে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Lander
বোমার রাত্রির সেই অভিজ্ঞতাকে জাগিয়ে রাখা
ড্রেসডেনের একটি পুরনো, পরিত্যক্ত গ্যাসের ট্যাংকে ১৯৪৫’এর বোমার রাত্রির ছবিগুলি প্যানোরামা হিসেবে দেখতে পাওয়া যাবে৷ শিল্পী হলেন ইয়াদেগর আসিসি৷ ছবিতে বোমা আক্রমণের অব্যবহিত পরে শহরের কেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখিয়েছেন আসিসি তাঁর প্যানোরামায়: চতুর্দিকে ধসে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি; ধোঁয়া উঠছে; কোথাও কোথাও লেলিহান অগ্নিশিখা৷
ছবি: Getty Images/Matthias Rietschel
9 ছবি1 | 9
একটা সময় পর্যন্ত জার্মানিতে প্রচলিত আইন অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ না থাকলে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতো না৷ এ কারণে অস্কার গ্র্যোনিংয়ের বিরুদ্ধেও এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি৷ কিন্তু পরে আইন সংশোধন করা হয়৷ এরই ফলে অস্কার গ্র্যোনিং এখন বিচারের সম্মুখীন৷
আজ, অর্থাৎ ২১ এপ্রিল মঙ্গলবার থেকে তাঁর বিচার শুরু হয়েছে ল্যুনবুর্গের স্থানীয় আদালতে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ৭০ বছর পরও গ্র্যোনিংয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ৬০ জনেরও বেশি মানুষ আসছেন যুক্তরাষ্ট্র, হাঙ্গেরি, ক্যানাডা এবং ইসরায়েল থেকে৷ ইভা পুসতাই এসেছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে৷ বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্কার গ্র্যোনিং যেখানে কাজ করেছেন সেখানেই হত্যা করা হয়েছে তাঁর মা আর বোনকে৷ গ্র্যোনিং ব্যাগ, টাকা-পয়সা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র রেখে দিয়ে তাঁদের হত্যাকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন- এ কথা ভাবলে এখনো তাঁর চোখ ভিজে যায়৷ ৯৩ বছর বয়সি এক ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করতেও তাই ছুটে এসেছে ইভা৷