জার্মানির জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে বলে জানিয়েছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তবে দেশটি সীমান্ত বন্ধের পক্ষে নয় বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান৷
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো সংবাদ সম্মেলন করেছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ গবেষকদের উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, জার্মানির জনসংখ্যার ৭০ ভাগ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন৷ এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়ায়, ছড়ানোর গতি কিভাবে কমানো যায় সেদিকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে জানান তিনি৷
বার্লিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘এই ভাইরাস ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা বা কার্যকর উপায় এখনও নেই৷ জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ তাই (করোনা ভাইরাসে) আক্রান্ত হবেন৷''
এরিমধ্যে জার্মানিতে ১২৯৬ জনের দেহে এই রোগের সংক্রমণ ধরা পড়েছে৷ এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে তিনজনের৷ যার মধ্যে তৃতীয়জন মারা গেছেন বুধবার৷ তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলের জেলা হাইন্সব্যার্গে৷
ম্যার্কেল এই পরিস্থিতিতে সবাইকে ঐক্য বজায় রাখার আহবান জানান৷ ‘‘ আমাদেরকে ঐক্য, বোধ-বুদ্ধি আর ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে এবং আশা করি সেই পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হব,'' বলেন ম্যার্কেল৷ এ সময় তিনি স্বাস্থ্য কর্মী এবং স্থানীয় প্রশাসনগুলোকে ভাইরাস প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান৷ ইটালির নাগরিকদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন৷
জার্মানির জীবনযাত্রায় করোনার প্রভাব
জার্মানিতে করোনার সংক্রমণ হাজার ছাড়িয়েছে৷ যার প্রভাবে দৈনন্দিন জীবনে আনতে হচ্ছে নানা পরিবর্তন৷ দর্শকহীন ফুটবল ম্যাচ বা ফ্লাইট বাতিল, অনুষ্ঠান বা মেলা স্থগিত কিংবা গাড়ি উৎপাদন কমে যাওয়া, সবই হচ্ছে করোনার প্রভাবে৷
ছবি: Imago Images/A. Hettrich
খাদ্য সহায়তা বন্ধ
জার্মানিতে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর সুপারশপ ও খাবারের দোকানগুলোতে লম্বা লাইন ধরে লোকজন নিত্যপণ্য কেনা শুরু করে৷ টিনজাত খাবার এবং টয়লেট পেপারের তাক তো খালিই থাকছে৷ এ অবস্থায় দেশটিতে দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ অথচ দেশটিতে ১৫ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Matzka
ফাঁকা স্টেডিয়াম
করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ভিড় এড়িয়ে চলা৷ যে কারণে বিশ্বজুড়ে অনেক আয়োজন বাতিল হয়ে গেছে৷ স্বাস্থ্য ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ‘ বিবেচনা করে খালি স্টেডিয়ামে জার্মান ফুটবল লীগের ম্যাচ আয়োজন করতে ক্লাব ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/O. Berg
একের পর এক অনুষ্ঠান বাতিল
করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর জার্মানিতে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা স্থগিত বা বাতিল করা হচ্ছে৷ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাইপৎশিশ বইমেলা, মুজিকম্যাসে ফ্রাঙ্কফুর্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
এখনো খোলা স্কুল
ইটালিতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ জার্মান সরকার এখনো এই সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ যদিও দেশটির অন্তত ১০০টি স্কুল ও ডে-কেয়ার সেন্টার করোনার কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে৷ বাডেন-ভ্যুটের্নবের্গ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিতের কথা ভাবছেন৷
ছবি: picture-alliance/SvenSimon/F. Hoermann
এশীয়রা বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন
চীনের উহান নগরীতে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়৷ যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে৷ করোনা আতঙ্কে পশ্চিমা দেশগুলোতে লোকজন শুধু চীন নয় বরং এশীয় রেঁস্তোরা ও দোকান এড়িয়ে চলছেন৷ এশীয় চেহারার কারণে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷ লাইপৎশিশে বুন্দেস লিগার ম্যাচ দেখতে যাওয়া একদল জাপানিকে স্টেডিয়াম থেকে বের করে দেওয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
এয়ারলাইন ব্যবসায় ভাটা
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে; বিশেষ করে এয়ারলাইনগুলোর৷ জার্মানির এয়ারলাইন লুফথান্সার ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ করোনা প্রাদুর্ভাবের পর তাদের প্রায় ১৫০ উড়োজাহাজ বসে আছে, বাতিল হয়েছে সাত হাজার ১০০র বেশি ফ্লাইট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
গাড়ি উৎপাদনে ধস
ডিসেম্বরের শেষ দিকে উহানে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর জানুয়ারি থেকে চীনে গাড়ি তৈরির কারখানা বন্ধ আছে৷ জার্মানির গাড়ি উৎপাদন শিল্পেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/J. Meyer
পর্যটক নেই
জার্মানির পর্যটন খাতে করোনার প্রভাব ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেছে দেশটির হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন৷ সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর ৭৬ শতাংশের বেশি হোটেল ও রেঁস্তোরা তাদের বুকিং বাতিল হওয়ার কথা জানিয়েছে৷ আয়ও একইভাবে হ্রাস পেয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Wurtscheid
সীমান্তে পরীক্ষা
ইটালি ও ফ্রান্সের পর ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতেই সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে৷ সোমবার পর্যন্ত সেখানে ১১৩৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন৷ যার প্রেক্ষিতে জার্মান সীমান্ত দিয়ে আসা গাড়ির যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা শুরু করেছে পোল্যান্ড ও চেকপ্রজাতন্ত্র৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Weigel
9 ছবি1 | 9
প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা এবং অর্থনৈতিক অভিঘাত সামলাতে ম্যার্কেল ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার উপরও জোর দেন৷
ইটালিতে এরই মধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন অন্তত ৬৩১ জন৷ এমন প্রেক্ষাপটে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সীমান্ত বন্ধে দাবি উঠছে৷ জার্মানির প্রতিবেশি অস্ট্রিয়া ইটালির নাগরিকদের সেখানে ঢুকতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তবে এর পক্ষে নয় জার্মানি৷ দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান জানিয়েছেন, সীমান্ত বন্ধ করে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো সম্ভব হবে না৷
এক হাজারের বেশি মানুষের জমায়েত হতে পারে এমন আয়োজন বাতিল করার আহবানও জানিয়েছিলেন স্পান৷ এই বিষয়ে জার্মানির ১৬ টি রাজ্যের কর্তৃপক্ষ শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷
এফএস/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)
প্লেগ থেকে করোনা: রোগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে নয়, তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের গবেষণাগারে, এমন গুজব হরহামেশাই ছড়াচ্ছে৷ শুধু করোনা নয়, যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সব মরণব্যাধী নিয়েই এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিস্তার লাভ করেছে৷
ছবি: zecken.de
প্লেগের কারণ ইহুদিরা
১৪ শতকে ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে৷ কারো জানা ছিল না কোথা থেকে এর উৎপত্তি৷ একটা সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে এই রোগ ছড়িয়েছে৷ প্লেগের পেছনে আছে ইহুদিরাই; এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়৷ জোরপূর্বক উচ্ছেদও করা হয় অনেককে৷
ছবি: picture-alliance/National Museum of Health and Medicine
স্প্যানিশ ফ্লু জার্মানির অস্ত্র
১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই ভাইরাসের উদ্ভব রহস্য হয়ে ছিল৷ অনেকে মনে করতেন জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই জীবাণু আবিষ্কার করে৷
ছবি: picture-alliance / akg
এইডস ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
১৯৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইডস ছড়িয়ে পড়ে৷ পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এ নিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করে সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবি৷ বলা হয় ফোর্ট ড্রেট্রিক-এ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে মার্কিনিরা এইচআইভি উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীতে প্রয়োগ করা হয় বন্দী, সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সমকামীদের উপর৷ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি আজও জনপ্রিয়৷
ছবি: Imago Images/ZUMA Press/D. Oliveira
ইবোলার দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের
নব্বইর দশকে এইডস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে৷ কিন্তু এ সময় আফ্রিকায় নতুন করে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে৷ যুক্তরাষ্ট্র এইডস ছড়িয়েছে এমন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এবার দাবি করল ইবোলার জন্যও তারাই দায়ী৷ সঙ্গে অবশ্য ব্রিটেনকেও জড়ানো হল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেন্টাগনের এঁটেল পোকা প্রকল্প
২০১৯ সালে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথ দাবি করেন পেন্টাগন এঁটেল পোকাসহ বিভিন্ন কীটের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প চালিয়েছে৷ এই গবেষণা চলেছে ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে৷ স্মিথ সম্প্রতি এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন৷
ছবি: zecken.de
কোভিড-১৯ কৃত্রিমভাবে ছড়ানো
ডিজিটাল যুগে যেকোন ভুল তথ্য আগের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়৷ বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে৷ একইভাবে এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বপ্রেমীদের দাবি নভেল করোনা ভাইরাস চীনের কোন গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে৷ সেখান থেকেই তা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে৷ কেউ কেউ দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রই জীবাণুটি তৈরি করে চীনে পাঠিয়েছে৷ যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই৷