৮৯ স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের লাভ-ক্ষতি
১১ ডিসেম্বর ২০২১কোভিডে দেড় বছর বন্ধ ছিল রাজ্যের স্কুল৷ গত মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলেছে৷ এখন নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির অফলাইন ক্লাস হচ্ছে৷ এরই মধ্যে স্কুল বন্ধের দুঃসংবাদ৷ রাজ্যের ৮৯টি স্কুল আপাতত বন্ধ হয়ে গেল৷ এই স্কুলগুলি জুনিয়ার হাই ও হাইস্কুল স্তরের৷ এই স্কুলগুলির অধিকাংশে পড়ুয়া নেই বললেই চলে৷ পড়ুয়ার অভাবেই স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্যদ৷ এই স্কুলগুলি থেকে ৩১১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বদলি করা হবে অন্যত্র৷ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে৷ বন্ধ হওয়া স্কুলের শিক্ষকদের সেখানে পাঠানো হবে৷ ইতিমধ্যে ১৭০ জনের বদলির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পর্ষদ৷
বন্ধ হওয়া স্কুল সবচেয়ে বেশি রয়েছে হাওড়াতে৷ খোদ কলকাতা-সহ এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম, আলিপুরদুয়ার ও অন্যান্য জেলা৷ স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘একজন ছাত্র থাকলেও একটা স্কুল চালাতে হবে৷ তবেই তো আরো পড়ুয়া আসবে৷ স্কুল তুলে দেওয়া কোনো সমাধান নয়৷ এই বিষয়টা নিয়ে আমি একেবারে বিভ্রান্ত৷ সরকারের উচিত এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া৷ কেন তারা স্কুল বন্ধ করল, এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার৷’’
জুনিয়র হাইস্কুল গড়ে ওঠার পেছনে কী কারণ? স্কুলছুটের সংখ্যা কমাতে সরকার এই ধরনের স্কুল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে, যাতে কোনো পড়ুয়াকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরে পড়তে যেতে না হয়৷ কিন্তু এই স্কুলগুলিতে মাত্র দু'-তিনজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল৷ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির পঠনপাঠনের জন্য সেই শিক্ষকরা বদলি বা অন্য কারণে স্কুল ছেড়ে দিলে সেই শূন্যস্থান পূরণ হয়নি৷ ফলে একজন শিক্ষকের পক্ষে সব ছাত্র সামলানো সম্ভব হতো না৷ সেক্ষেত্রে অভিভাবকরা অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত বড় স্কুল, যেখানে প্রায় হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে, সেখানে ছুটেছেন৷ আর ক্রমশ শূন্য হয়ে পড়েছে জুনিয়র হাইস্কুল৷
প্রথম থেকেই স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ৷ এই সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, ‘‘সরকারের উদাসীনতার ফলেই স্কুলগুলি রুগ্ন হয়ে পড়েছে৷ পর্যাপ্ত শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ করা হয়নি৷ এর ফলে ক্রমশ ছাত্রশূন্য হয়ে গিয়েছে স্কুলগুলি৷ সরকারের উচিত ছিল যথাযথভাবে নিয়োগ করে, পরিকাঠামো উন্নত করে স্কুলগুলিকে পঠনপাঠনের উপযোগী রাখা৷ সেটা না করাতেই স্কুল বন্ধ করে দিতে হচ্ছে৷’’
করোনা আবহে একদিকে অভিভাবকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে, বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা৷ সংসারের আর্থিক কারণে যেমন নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি অনেক পড়ুয়া শিশুশ্রমিকের কাজ নিয়ে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছে৷ সম্প্রতি সুন্দরবনের কুলতলির একটি স্কুলে প্রায় শতাধিক পড়ুয়া স্কুলছুট৷
এরকম পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলবে? শিক্ষাবিদ ও জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভিজিৎ পাঠক বলেন, ‘‘কোভিডের দেড় বছরে ল্যাপটপ, মোবাইল না থাকায় শিক্ষায় গরিব পরিবারের ছাত্ররা পিছিয়ে পড়েছে৷ এলিটদের সুবিধা হয়েছে৷ স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে এই ফারাক আরো বাড়বে৷’’ স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষালাভ শিশুর অধিকার৷ প্রত্যেক এলাকায় স্কুল থাকা দরকার৷ কোভিড পরবর্তী সময়ে যখন বিধি মেনে স্কুল খোলার পর্ব চলছে, সেই সময় স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত মানা যায় না৷’’ এতে দূরের স্কুলে ছেলে-মেয়েদের পাঠানোর প্রবণতা কমবে, বাড়বে ড্রপ আউট৷
সরকারি স্কুল বন্ধ হলে তা যে আদতে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণে সাহায্য করবে, এমনটা মনে করছে শিক্ষা মহলের একাংশ৷ কিঙ্কর বলেন, ‘‘যদি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যায় বা পরিকাঠামো না থাকে, তাহলে সঙ্গতিসম্পন্ন অভিভাবকরা বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকবেন৷ যদি প্রাথমিক স্কুলের কথাই ধরেন, তাহলে দু'-তিনজন কর্মী দিয়ে সেই স্কুল চলে৷ আর নার্সারি স্কুলের ১৭-১৮ জন কর্মী থাকেন৷ সেখানকার পরিকাঠামো, পঠনপাঠন ভালো হওয়ার সুযোগ তো থাকবেই৷’’