একটা ঐতিহাসিক দিন, জার্মানদের নিজস্ব দিন – এবং সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু, বিশেষ করে সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষদের কাছে৷ কিন্তু ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্র এবং সেই সঙ্গে ইউরোপের পক্ষে দিনটার তাৎপর্য কম নয়৷
বিজ্ঞাপন
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর৷ দিনটা ছিল এক আশ্চর্য দিন৷ সন্ধ্যায় সেই আমলা-মার্কা ঘোষণা, ‘এখন থেকে সবার যাতায়াতের স্বাধীনতা থাকবে'৷ সেখান থেকে শুরু করে সে'রাতে বার্লিন প্রাচীরের পতন অবধি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জার্মান তথা ইউরোপীয়দের জীবন পাল্টে যায়৷ কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি গণআন্দোলন আর পলায়নপর নাগরিকদের চাপে ভেঙে পড়ে৷ বার্লিন প্রাচীরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জিডিআর'এর অন্ত ঘটে – যদিও পুনরেকত্রীকরণ ঘটে তার এক বছর পরে৷ জিডিআর'এর অস্তিত্বেরই আর কোনো কারণ থাকে না - এক ওয়ারশ' জোটের সদস্যতা ছাড়া৷
ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর পতনের ২৫ বছর
আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মধ্য দিয়ে দুই জার্মানির একত্রীকরণ হয়েছিল৷ তৎকালীন পূর্ব জার্মানির শান্তিপূর্ণ বিপ্লব, বার্লিন প্রাচীরের নানা কথা থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বের ইতিহাস বদলে দেয়া আন্দোলন
২৫ বছর আগে পূর্ব জার্মানির লাইপশিস শহরে শান্তিপূর্ণ মিছিলের মধ্য দিয়ে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে মিছিলে অংশ নিয়েছিলো ৭০,০০০ মানুষ৷ সেই মিছিলের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য শহরেও৷ ভেঙে গিয়েছিল বার্লিন প্রাচীর৷ বিশ্বের ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল এক নতুন ইতিহাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘চেক পয়েন্ট চার্লি’
বার্লিন প্রাচীর ঘেঁষে ছিল এই সীমান্ত পাহারা কেন্দ্রটি, যেটা চেক পয়েন্ট চার্লি নামেই পরিচিত ছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনীর সেনা এবং কূটনীতিকরা যাতায়াত করতেন এই রাস্তা দিয়ে৷ রাস্তাটি ছিলো ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত৷ বর্তমানে এই ঐতিহাসিক জায়গায় একটি মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
এখন তাঁরা সবাই এক জনগোষ্ঠী
যে প্রাচীর টপকাতে গেলেই মৃত্যুর ভয় ছিলো সে প্রাচীর খুলে দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরই সমস্ত ভয় কেটে যায় জার্মান জনগণের৷ প্রাচীরের সামনে পেছনে, ওপরে, সব জায়গায়ই যেন আনন্দের বন্যা বইছিল৷ এখন পূর্ব আর পশ্চিমের মানুষ বলে কিছু নেই, এখন তাঁরা সবাই এক জনগোষ্ঠী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রতিবাদ আন্দোলন পোঁছে পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিনে৷ হাজার হাজার মানুষ সংস্কার ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে৷ তবে তাঁদের লক্ষ্য ছিলো, এসময় যেন কোনো হিংসাত্মক ঘটনা না ঘটে৷ এটা ছিলো পূর্ব জার্মানি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ৷
ছবি: Reuters/Hannibal
বিরোধীরা আরো সক্রিয় হয়
পূর্ব বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাৎসে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভটি সরাসরি টিভিতে সম্প্রচার করা হয়৷ বিক্ষোভকারীরা ভ্রমণ ও সমাবেশ অনুষ্ঠানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানায় সেখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Martti Kainulainen
স্বপ্ন যখন সত্য হয়
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর রাতে অনেক স্মরণীয় ঘটনা ঘটে৷ মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব জার্মানির শত শত নাগরিক হেঁটে, সাইকেলে এবং ট্রামান গাড়িতে করে পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশ করে৷ সেদিন চেক পয়েন্ট চার্লি বা সীমান্ত পাহাড়া কেন্দ্রে মানুষ আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে, ঠিক যেন কোলনের কার্নিভালের মতো৷
ছবি: imago/Sven Simon
বার্লিন প্রাচীরের আসল টুকরো
ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজনীতিকদের লক্ষ্য ছিলো ১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর তৈরির সময়কার কিছু ইটের নমুনা যেন বন শহরের ইতিহাস বিষয়ক মিউজিয়ামে স্থান পায়৷ আজ সেই স্মৃতিচিহ্ন মিউজিয়াম দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়৷
ছবি: DW/H. Mund
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বরের রাতে ডয়চে ভেলের বিভিন্ন ভাষা বিভাগের কর্মীরা সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য ‘ভ্রাম্যমাণ ট্রান্সমিটার’ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন ডুডারস্টাট শহরের সীমান্তে৷ সে দলের সঙ্গী হয়ে ছিলাম আমিও৷ পূর্বের মানুষেরা এত বছর পর কীভাবে মিলিত হচ্ছেন পশ্চিমের মানুষদের সঙ্গে সেটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার৷ সবার চোখে ছিল জল আর ঠোঁটে হাসি৷ স্বচক্ষে দেখা এ ঘটনা কোনোদিনই ভোলার নয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
কলকাতায় উদযাপন
বার্লিনের প্রাচীর পতনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জার্মান কনসুলেটের উদ্যোগে কলকাতায় নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ এর মধ্যে আন্তর্জাতিক গ্রাফিতি ও হিপ হপ কর্মশালা উল্লেখযোগ্য৷ ছবির এই দেয়ালচিত্রটি কলকাতা থেকেই পাঠানো৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কূটনীতিকদের বাগানে রিফিউজি ক্যাম্প
১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মে সাবেক পূর্ব জার্মানির জনগণের কাছে এই জায়গাটি খুবই জনপ্রিয় ছিলো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
তা সত্ত্বেও গর্বাচভ'-এর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বার্লিনের ক্ষমতাসীন শাসকরা বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন৷ বেইজিং-এর স্বর্গীয় শান্তির চত্বরে যেমনটা হয়েছে, তেমন কোনো ‘‘চৈনিক সমাধান'' পূর্ব জার্মানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি৷ ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানি, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি কিংবা ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার মতো ১৯৮৯ সালে পূর্ব জার্মানির স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হয়নি৷ বার্লিন প্রাচীরের পতন পুবের জার্মানদের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ করে৷
৯ নভেম্বর ছিল এক সুখের, আবেগের দিন৷ এ'দিনে সব বিস্মৃত, অবহেলিত অনুভূতি আবার ফুটে ওঠে: দু'তরফেই পুনর্মিলনের আকাঙ্খা; পুবের মানুষদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা৷ জার্মানরা, বিশেষ করে বার্লিনের মানুষজন যেন ঘোরে ছিলেন৷ এমন এক আনন্দের অনুভূতি, যা আমাদের অনেককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিল৷ সেই অনুভূতিই আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ৪০ বছরের বিভাজনও দুই জার্মানির আত্মীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি৷ এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে উইলি ব্রান্ড'এর সেই চিরন্তন, অপরূপ কথাগুলি: ‘‘যা একসঙ্গে হবার কথা, তা'ই এখন একসঙ্গে হচ্ছে''৷ জার্মান কথাটা হলো ‘ওয়াকসেন', মানে গজিয়ে ওঠা, লতাপাতার মতো, প্রকৃতির মতো৷ সেই উদ্ভিন্ন জার্মান ঐক্যে কিন্তু জার্মানির প্রতিবেশীদের কোনো বিপদ ঘটেনি৷ ১৯৮৯ সালের শান্তিপূর্ণ বিপ্লব জার্মানিকে ইউরোপের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে৷
পুবের জার্মানদের বিদ্রোহ ছিল কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যে ‘‘তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্র'' সব কিছুকে নিয়মের জালে জড়িয়ে রাখে, বেঁধে রাখে৷ পুবের জার্মানরা বিদ্রোহ করেছিলেন এক উন্মুক্ত দেশের দাবিতে, যে দেশে মানুষজনকে আটকে রাখা হয় না৷ যে কারণে যাত্রার স্বাধীনতা ছিল তাদের একটি কেন্দ্রীয় দাবি৷ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানোর দাবিটা অত জোরালো ছিল না৷ যে কারণে ইতিহাসের একটি রসিকতা হলো এই যে, পুনরেকত্রিত জার্মানির রাজনৈতিক ডিএনএ'তে একটি ‘‘শক্তিশালী কল্যাণরাষ্ট্রের'' স্বপ্ন ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত৷
৯ নভেম্বরের পর জার্মানি আরো বেশি প্রোটেস্টান্ট, আরো বেশি পূর্বমুখী, আদর্শবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আরো বেশি মধ্যমপন্থি এবং কম বিতর্কিত হয়ে উঠেছে৷ বলতে কি, জার্মানি যেন আরো বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠেছে৷ এই জার্মানির প্রতিনিধিত্ব এবং শাসনের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক পূর্ব জার্মানির দুই নাগরিক: ইওয়াখিম গাউক এবং আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ জার্মানির অভ্যন্তরীণ ঐক্যও অনেক দূর এগিয়েছে, যদিও অনেকের কাছে তা এখনও দৃষ্টিগোচর নয়৷ সেই ঐক্যের সূচনা ঘটে ৯ নভেম্বর ১৯৮৯'র সুখস্মৃতিতে৷