জনপ্রিয় ব্লগ সাইট ইস্টিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে৷ ব্লগটির প্রধান অ্যাডমিন নুর নবী দুলাল দাবি করেছেন, ‘‘বিটিআরসি কোনো নোটিস না দিয়ে কারণ ছাড়াই ব্লগটি বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করে আছি আমি৷''
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের আইএসপি প্রোভাইডারদের সংগঠন আএসপিবিএ-এর সভাপতি আমিনুল হাকিম মঙ্গলবার ডিডাব্লিউ-কে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন-এর (বিটিআরসি) লিখিত নির্দেশে সোমবার থেকে ইস্টিশন ব্লগ নামের ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিয়েছি আমরা৷ ব্লগটির ওয়েব অ্যাড্রেসসহ সব ধরনের লিংক ব্লক করা হয়েছে৷ তবে বিটিআরসি আমাদের সাইটটি বন্ধ করতে লিখিত নির্দেশ দিলেও, কোনো কারণ জানায়নি৷''
আমিনুল হাকিম
তবে এ নিয়ে বিটিআরসি-র সচিব এবং মুখপাত্র সরোয়ার আলমের সঙ্গে টেলিফোন মারফত যোগাযোগ করলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কত ওয়েবসাইটই তো আছে৷ এর মধ্যে ইস্টিশন ব্লগ বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিনা, তা এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না৷ আমি এখন সচিবালয়ে মিটিং-এ আছি৷ অফিসে গিয়ে কাগজ-পত্র দেখে বলতে পাববো৷''
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়, অর্থাৎ ২০১৩ সালে, ইস্টিশন ব্লগের যাত্রা শুরু হয়৷ সর্বশেষ ব্লগটির সাত হাজার রেজিস্টার্ড ব্লগার ছিল৷ বাংলাদেশে ব্লগটি বেশ জনপ্রিয়৷ ফেসবুকে যোগাযোগের পর, টেলিফোনে অজ্ঞাত স্থান থেকে ইস্টিশন ব্লগের প্রধান অ্যাডমিন নুর নবী দুলাল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ বা নেটিস ছাড়াই ব্লগটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ আমরা আইএসপি প্রোভাইডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা জানান যে, বিটিআরসি-র নির্দেশেই ইস্টিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ আমরা অবশ্য এখনো বিটিআরসি-র সঙ্গে এ নিয়ে সরাসরি কোনো যোগাযোগ বা কথা বলিনি৷''
দুলাল বলেন, ‘‘এভাবে কোনো কারণ ছাড়াই একটি ব্লগ সাইট বন্ধ করে দেয়া বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, মুক্ত চিন্তার প্রতি হুমকি৷ সাত হাজার ব্লগার এখানে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতেন, লেখালেখি করতেন৷ তাঁদের এভাবে রুদ্ধ করে দেয়া হলো৷ একদিকে মুক্তমনা ব্লগাররা ধর্মান্ধদের হামলার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার ব্লগ সাইট বন্ধ করে দিচ্ছে৷ অর্থাৎ এখন দুই দিক থেকেই বাকস্বাধীনতা হুমকির মুখে৷ আমি আমাদের ব্লগটিকে উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি৷''
নূর নবী দুলাল
দুলালের কথায়, ‘‘২০১৩ সালে এই ব্লগটি চালু করার পর থেকে আমি অব্যাহতভবে হুমকির মুখে আছি৷ আমাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়েছে৷ আমি দেশেও থাকতে পারিনি৷ আমাকে এখন পরিবার ও দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে৷ এক দুঃসহ জীবনযাপন করছি আমি৷ কিন্তু তারপরও ব্লগ ছাড়িনি৷ ব্লগের প্রতি ভালোবাসার কারণে সব সহ্য করেছি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার ব্লগটাই বন্ধ করে দিলো৷''
এদিকে ইস্টিশন ব্লগ খুলে দেয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে৷ একটি ক্যাম্পেইনের শিরোনাম: ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ – ভেঙে দাও কণ্ঠরোধের শৃঙ্খল৷''
এর আগে বাংলাদেশের আরেকটি জনপ্রিয় ব্লগ সাইট ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ'-এর কিছু লিংক বন্ধ করে দিয়ছিল বিটিআরসি৷ তবে সাইটটি পুরোপুরি বন্ধ করেনি৷ গত আগস্টে বিটিআরটি ৩৫টি নিউজ ও ব্লগ সাইট বন্ধ করে দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরোধে৷
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’