অন্যান্য যে কোনো দেশের মতোই, জার্মানির আয়কর ব্যবস্থা করের পরিমাণ, আদায় ও ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁকি, এই তিন কাণ্ডে বিভক্ত৷ তবে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ সাধারণত শুধু ‘‘বড় মাছদেরই'' থাকে, জার্মানরা যেমন বলে থাকেন৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ বা ভারতের মতো জার্মানিতেও প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স সিস্টেম চালু৷ ক্রমবর্ধিষ্ণু কর ব্যবস্থায় আয় যত বেশি হবে, করের পরিমাণও বাড়বে সেই অনুপাতে৷ হালে জার্মানিতে শূন্য থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে৷ ২০১৬ সালের কথাই ধরা যাক৷
বর্তমানে জার্মানিতে একক ব্যক্তিদের জন্য ৮,৬৫২ ইউরো, অথবা বিবাহিত দম্পতিদের জন্য ১৭,৩০৪ ইউরো অবধি আয় করমুক্ত৷ পরের স্ল্যাব, অর্থাৎ একক ৫৩,৬৬৫ ইউরো/দম্পতি ১০৭,৩৩০ ইউরো অবধি আয়কর বাড়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে ১৪ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত৷ পরের স্ল্যাবে একক ২৫৪,৪৪৬ ইউরো/দম্পতি ৫০৮,৮৯২ ইউরো অবধি আয়কর ধার্য হয় ৪২ শতাংশ৷ তার ওপরে করের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ, আয় যতই হোক না কেন৷ গোটা আয়ের ওপরে বসে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ‘সলিড্যারিটি সার্চার্জ' বা সংহতি অধিশুল্ক, সাবেক পূর্ব জার্মানিকে পশ্চিমাঞ্চলের পর্যায়ে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে যা চালু করা হয়েছিল৷
‘ট্যাক্সেবল ইনকাম', অর্থাৎ আয়ের যে অংশের ওপর কর বসে, তা নিরূপণ করার জন্য মোট আয় থেকে কিছু কিছু আইটেম বাদ দেওয়া হয়, যেমন ১৮ বছরের নীচে সন্তানদের খোরপোশের দরুণ একটি থোক পরিমাণ; অথবা স্বাস্থ্য, পেনশন, বেকারত্ব ও বার্ধক্য বা অসুস্থতা জনিত দীর্ঘমেয়াদি বীমার প্রিমিয়ামের খরচ ইত্যাদি৷
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আয়করের পরিমাণ
জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কী পরিমাণ আয়কর বা ট্যাক্স দিতে হয়, তা নিয়েই এই ছবিঘর৷ তবে এ সব দেশে আয়করের পরিমাণ বেশি হলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত, সমাজকল্যাণে বা অবসর খাতে নানারকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়৷
ছবি: CC BY-SA 3.0/Pilgab
জার্মানি
আয়করকে মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে জার্মানিতে৷ যাদের বাৎসরিক আয় ২৫ হাজার ৭৩১ ইউরোর বেশি, তাদের দিতে হয় সবচেয়ে বেশি ৪৫ ভাগ ট্যাক্স৷ যাদের বেতন বছরে ০ থেকে ৮,৩৫৪ ইউরো তাদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না৷ আর ৮,৩৫৫ থেকে ১৩,৪৬৯ ইউরো যাদের বেতন, সেই সব মানুষদের ট্যাক্স দিতে হয় আয়ের ১৪ থেকে ২৩.৯৭ শতাংশ৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
ফ্রান্স
ফ্রান্সেও আয়কর পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত৷ বাড়িতে ক’জন বসবাস করে তার উপর নির্ভর করে আয়কর৷ এছাড়া যাদের আয় বছরে ৫,৯৬৩ ইউরো পর্যন্ত, তাদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না৷ অন্যদিকে যাদের আয় ৭০,৮৩০ ইউরো বা তার বেশি তাদের সবচেয়ে বেশি, মোট আয়ের ৪১ শতাংশ কর হিসেবে দিতে হয়৷
ছবি: Fotolia/lapas77
নেদারল্যান্ডস
এই দেশে আয়করকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি আয়কর বা ট্যাক্স দিতে হয় তাদের, যাদের আয় বছরে ৫৭,৫৮৫ ইউরো বা তার বেশি৷ এদের আয়ের ৫২ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়৷ যাদের বাৎসরিক আয় ০ থেকে ১৯,৮৮২ ইউরো তাদের আয়কর দিতে হয় ১.৮৫ ভাগ, যার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত নয়৷ সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা নিতে চাইলে ৩৩ ভাগ ট্যাক্স দিতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Grubitzsch
স্পেন
স্পেনে আয়কর আটটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত৷ যাদের বছরে আয় ৫,১৫০ ইউরো, তাদের কোনো আয়কর দিতে হয় না৷ আর যাদের আয় বছরে ৩০ লাখ ইউরো বা তার বেশি, সরকারকে সর্বোচ্চ ৫২ ভাগ ট্যাক্স বা মোট বেতনের ৫২ শতাংশ কর বাবদ দিতে হয় তাদের৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/K. Thomas
সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডে মোট আয়ের সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ ট্যাক্স হিসেবে দিতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/robertharding
সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে
স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতে আয়কর অনেক বেশি৷ এই যেমন সুইডেন ও ডেনমার্কে সর্বোচ্চ ৫৬.৬ ভাগ আয়কর দিতে হয়৷ অন্যদিকে নরওয়েতে সর্বোচ্চ আয়কর দিতে হয় আয়ের ৪৬.৯ শতাংশ৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
ইটালি
ইটালিতে আয়কর পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত৷ বছরে ১৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত যাদের আয়, তাদের ট্যাক্স দিতে হয় বেতনের ২৩ ভাগ অর্থ৷ আর যাদের আয় বছরে ৭৫ হাজার ইউরো বা তার বেশি তাদের সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Merola
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে আয়কর চারটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত৷ যাদের আয় বছরে ১১ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত, তাদের কোনো আয়কর দিতে হয় না৷ অন্যদিকে যাদের আয় বছরে দেড় লাখ পাউন্ড বা তার চেয়ে বেশি তাদের সর্বোচ্চ ৪৫ ভাগ আয়কর দিতে হয়৷
ছবি: CC BY-SA 3.0/Pilgab
8 ছবি1 | 8
কর আদায়
জার্মানিতে সরকারের পক্ষে কর আদায় করা সোজা, কেননা ‘লোনস্টয়ার' বা ‘ওয়েজ ট্যাক্স', অর্থাৎ বেতন বা পারিশ্রমিকের উপর কর মালিক বা নিয়োগকারী সংস্থাই বেতন দেবার সময় কেটে রাখে ও কর বিভাগে পাঠিয়ে দেয়৷ বাকি সমস্ত উৎস থেকে আয় বাৎসরিক ‘ট্যাক্স রিটার্ন' পেশ করার সময় দেখাতে হয়; একে বলা হয় ‘আইনকমেন্সশ্টয়ার' বা ‘ইনকাম ট্যাক্স', অর্থাৎ আয়কর৷ মনে রাখতে হবে, জার্মান সরকারের মোট রেভেনিউ-এর এক-তৃতীয়াংশ আসে এই আয়কর থেকে৷
আগের বছর নির্ধারিত করের পরিমাণ অনুযায়ী পরের বছরের প্রি-পেমেন্ট, মানে আগাম কর দিতে হয় প্রতি তিন মাস অন্তর চার থোকে, ১০ই মার্চ, ১০ই জুন, ১০ই সেপ্টেম্বর ও ১০ই ডিসেম্বর তারিখে৷ পরে ট্যাক্স রিটার্নের সঙ্গে মিলিয়ে সেই আগাম দেওয়া করের একাংশ ফেরৎ দেওয়া হয় কিংবা বকেয়া পরিমাণ দাবি করা হয়৷
কর ফাঁকি
জার্মানিতে বাঁধা মাইনের চাকুরেদের কর ফাঁকি দেওয়া সুযোগ বিশেষ নেই৷ এখানকার অফিস-কাছারির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট সমৃদ্ধ, উন্নত দেশসুলভ দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করে থাকে৷ সরকারি কর বিভাগের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য৷ জনসংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল রেখে, একটানা উৎপাদন ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে, সাধারণ জীবনযাত্রার সংস্থান ও মানকে এরা সমৃদ্ধির এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে ব্যক্তি বা সরকার পর্যায়ে একক দুর্নীতি বিরল বলা চলে৷ আয়করের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য৷
সফল ও বিত্তশালীদের মধ্যে যারা মাঝে মধ্যে ‘কোনো কোনো বছরে' তাদের আয়ের ‘কোনো কোনো অংশ' ট্যাক্স রিটার্নের মাধ্যমে কর বিভাগকে জানাতে ‘ভুলে যান', তাদের জন্য রয়েছে ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার', অর্থাৎ নিজে থেকেই ত্রুটিস্বীকার৷ অবশ্য কর বিভাগের টনক নড়ার আগেই সেটা করতে হবে, তবেই বিচারবিভাগীয় সাজার বদলে শুধুমাত্র বকেয়া কর ও সুদ দিয়ে ছাড় পাওয়া যাবে৷
মজা হলো এই যে, বাংলাদেশ বা ভারতে সর্বোচ্চ স্ল্যাবের কর যেখানে ২৫ বা ৩০ শতাংশ ছাড়ায় না, জার্মানিতে কিন্তু সেই সর্বোচ্চ কর ৪৫ শতাংশ৷ কাজেই যাদের আয় বিপুল, তারাই কর ফাঁকি দেওয়ার প্রলোভনে পড়েন৷ বাড়তি আয় গোপন করার যতোরকম পন্থা আছে – যেমন বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখা, দ্বীপান্তরে লেটারবক্স সম্বল কোম্পানি খুলে টাকা পাচার করা – এক শ্রেণির জার্মানরা এ সবই করে থাকেন৷
আপাতত এতে বাদ সাধছে সিডি-তে স্টোর করা চোরাই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চোরাই তথ্য, যা মাঝেমধ্যেই জার্মানির প্রাদেশিক অর্থ বিভাগগুলিকে অফার করা হয়ে থাকে, অবশ্যই নগদ মূল্যে৷ তবে বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক প্রেসিডেন্ট উলি হ্যোনেস, সাবেক টেনিস তারকা বরিস বেকার, কিংবা ডয়চে পোস্টে-র সাবেক সিইও সুমভিংকেল, এদের সকলেই আয়করের জাল থেকে কিছুদিন পালিয়ে থাকতে পেরেছেন বটে, কিন্তু শেষমেষ ধরা দিতে বাধ্য হয়েছেন৷
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷